Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে ঃ প্রধানমন্ত্রী

॥স্টাফ রিপোর্টার॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলব না। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। করোনা মহামারী যখন থামবে তখন আমরা খুলবো।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ২৭শে এপ্রিল সকালে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ ও সংকট মোকাবেলা সমন্বয়ে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে মতবিনিময়কালে এই ঘোষণা দেন।

জেলাগুলো হচ্ছে ঃ বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রাজশাহী এবং সিরাজগঞ্জ।

করোনা ভাইসের প্রকোপ বাড়তে থাকায় গত ১৭ই মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ২৬শে মার্চ থেকে সব অফিস আদালত ও যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকতে বলা হয়।

গত ২৩শে এপ্রিল সেই ‘সাধারণ ছুটির’ মেয়াদ আগামী ৫ই মে পর্যন্ত বাড়িয়ে আদেশ জারি হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটিও একই সময় পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টানা বন্ধ থাকায় পাঠদানের ধারাবাহিকতা রাখতে ২৯শে মার্চ থেকে সংসদ টিভিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এবং গত ৭ই এপ্রিল থেকে প্রাথমিক শ্রেণীর ভার্চুয়াল শ্রেণী কার্যক্রম শুরু করা হয়।

ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসন, জনপ্রিতিনিধি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি, পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সিভিল সার্জন-চিকিৎসক নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মসজিদের ইমাম, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মতবিনিময় করেন। স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে মহাখালীস্থ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ-দপ্তর এবং আইইডিসিআর ও ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। পিএমও সচিব তোফাজ্জেল হোসেনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ গণভবন প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, বেসরকারী টিভি এবং রেডিও চ্যানেলে ভিডিও কনফারেন্স সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। পাশাপাশি কয়েকটি ফেইসবুক পেইজেও লাইভ ষ্ট্রিমিং যায়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেছেন, কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এই কয়মাস সবকিছু বন্ধ থাকায় ঋণের সুদ হয়ে গেছে, সেটার জন্য আপনারা চিন্তা করবেন না। কারণ এই সুদ এখনই নেয়ার কথা নয়। আর এ বিষয়ে আপনাদের সাথে মিটিংয়ের পর অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আবার বসবো। কাজেই এই সুদ যেন স্থগিত থাকে এবং পরবর্তীতে কতটুকু মওকুফ করা যায় এবং কতটুকু আপনারা নিয়মিত দিতে পারেন, সেটা বিবেচনা করা হবে। কজেই দুশ্চিন্তায় ভুগবেন না।’

করোনা ভাইরাস পরবর্তী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় তাঁর সরকার ঘোষিত প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদণার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের মৎস চাষি থেকে শুরু করে, পোলট্রি, ডেইরী বা যারা কৃষিকাজ ও বিভিন্ন ধরনের ছোটখাটো ব্যবসা করেন তাঁদের প্রত্যেকের কথা চিন্তা করে এবং অন্যান্য দিকে খেয়াল রেখেই এই এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। যেখান থেকে মাত্র ২ শতাংশ সুদে টাকা দেয়া হবে, যাতে তাঁরা তাঁদের ব্যবসা চালু রাখতে পারেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের কাজ নেই। বিশেষ করে একেবারে নিম্ন আয়ের লোক, এমনকি ছোটখাটো কাজ করে যারা খায়, তাদের কষ্ট আমরা জানি। কৃষির জন্য পৃথক ৫হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন, যেখানে ৯ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি প্রায় ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজি দরে ওএমএস’র চাল বিতরণ কর্মসূচির কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আরো বলেন, চলতি বোরো মওসুমে সরকারের পক্ষ থেকে ২১ লাখ মেট্রিক টন ধান-চালসহ খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। একইসঙ্গে করোনা মোকাবেলায় ৬৪ জেলায় ৯৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও ৪০ কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান এবং জেলার ত্রাণ ও করোনাপরিস্থিতি সমন্বয়ে ৬৪ জন সচিবকে ৬৪ জেলার দায়িত্ব প্রদানসহ সরকারের নানামুখি পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করেন।

তাঁর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের ৫০ লাখ সুবিধাভোগীর সঙ্গে আরো ৫০ লাখ যোগ করার জন্য রেশনকার্ড প্রদানের তালিকা প্রণয়নকালে যাদের প্রয়োজন তারা যেন কেউ বাদ না পড়ে তা নিশ্চিত করতে তাঁর নির্দেশের কথাও পুনরোল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘ভিজিডি, ভিজিএফ এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচির বাইরে যারা রয়েছেন, যারা করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু হাত পেতে চাইতে পারছেন না তাদের প্রকৃত তালিকা করার জন্য আমি আমার দলের নেতা-কর্মীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিচ্ছি।’

তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা। আর আমাদের জীবন-জীবিকার পথটা উন্মুক্ত রাখা। রমজানের মাঝামাঝি সময়ে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখেও সরকারের পক্ষ থেকে আরো সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যেই আমরা চাল এবং টাকা বিতরণ করছি। রমজানের মাঝামাঝি সময়ে ঈদকে সামনে রেখে আমরা আরেক দফায় খাদ্য বিতরণ করবো। যাতে রমজানে কেউ কষ্ট না পান, সেই বিষয়টা অবশ্যই আমরা দেখবো।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘যেসব জায়গায় করোনা ভাইরাস বেশি নয়, ধীরে ধীরে সেসব জায়গাগুলো শিথিল করে দিচ্ছি। যাতে মানুষ সাধারণ জীবন-যাপন করতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘আপনারা যদি নিজেদের সুরক্ষিত রেখে এই সংক্রমনের হার কমাতে পারেন, যাতে মৃত্যুর হারও কমে, তাহলে আমরা আস্তে আস্তে আপনাদের যোগাযোগ, যাতায়াত, পণ্য পরিবহনসহ অন্যান্য কিছু উন্মুক্ত করে দেব।’ ইতোমধ্যেই পণ্য পরিবহনকে উন্মুক্ত করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

দুর্ভিক্ষ এড়াতে সাধ্যমতো ফসল উৎপাদন এবং দেশে কোন জমি যেন পতিত না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্যও দেশবাসীর প্রতি তাঁর উদাত্ত আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।

পাশাপাশি একজমিতে একাধিক ফসল ফলানোসহ ঘরের পাশের এক চিলতে জায়গাটুকুও কাজে লাগানো, বাড়ির ছাদে টবে তরি-তরকারি, ফল-মূলের চাষ এবং মৎস্য ও গবাদিপশু প্রতিপালনের ওপর ও গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে পাঁচ দফা পৃথক ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ৫১টি জেলার সঙ্গে মতবিনিময় করেন। করোনা সংক্রমন প্রতিরোধে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং ঘরে অবস্থান করার জন্য তিনি আহবান জানিয়ে ছিলেন।

গতকাল সোমবার সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার এবং ঘরে অবস্থান করার আহবানের পুনরোল্লেখ করে করে রমজান মাসে তারাবির নামাজ ঘরে বসে আদায়ের আহ্বান পুনরাবৃত্তি করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে রমজানের মোবারকবাদ জানিয়ে আমি এটুকুই বলবো, সকলে আল্লাহর দরবারে কায়মনো বাক্যে দোয়া করেন- করোনা ভাইরাস থেকে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্বের মানুষ যাতে মুক্তি পায়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, এই দুঃসময় থাকবে না, এটি আমরা কাটিয়ে উঠবো। আমাদের কল-কারখানাসহ সবই আবার চালু হবে এবং দেশের অর্থনীতি আবার সচল হয়ে উঠবে। আমাদের আলোর পথের যাত্রা আবারো শুরু হবে।’

করোনা ভাইরাস চিকিৎসায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা করোনা রোগীদের দেখাশোনা করছেন তাঁদের প্রণোদনা দিয়েছি। যদি কেউ অসুস্থ্য হন তাদের বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। সেইসঙ্গে আমরা ৫ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সহায়তা দেব। তাদের ভালো-মন্দ দেখছি এবং তারাও যেন সুরক্ষিত থাকে যা যা প্রয়োজন সেটা দিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসরণ করে ৩ হাজার ৪৬৪ জন চিকিৎসক অনলাইনে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী সিরাজগঞ্জের সঙ্গে মতবিনিময়কালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার চাপ সামাল দিতে সরকারের আরো ২ হাজার ডাক্তার এবং ৬ হাজার নার্স নিয়োগের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

তিনি পাবনার সঙ্গে মতবিনিময়কালে রূপপুর পারমানবিক প্রকল্পে কর্মরত, যারা বিদেশ থেকে কাজে যোগ দিতে আসবে তাদের কাজে যোগদানের পূর্বে দুই সপ্তাহের কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্যও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেরপুর উপজেলার ঝিনাইগাতি গ্রামের নিঃস্ব ও পঙ্গু নাজিম উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে তার সর্বস্ব প্রায় ১০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহযোগিতার বিরল উদাহরণ টেনে সমাজের বিত্তবানদের আরো উদার হস্তে এগিয়ে আসারও আহবান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, দুর্যোগ আসে এবং সেই দুর্যোগকে মোকাবেলাও করতে হয়। আজ এই দুর্যোগ থেকে উত্তরণে দেশের সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘যারা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাদেরকে আপনাদের সহযোগিতা করতে হবে। সবাই মিলেই আমরা এই পরিস্থিতির থেকে মুক্তি পাব, ইনশাল্লাহ।’