॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন/কবির হোসেন॥ “বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়, লিগ্যাল এইড অফিসে আপোষও হয়”-এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস উপলক্ষে রাজবাড়ী জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির আয়োজনে গতকাল ২৮শে এপ্রিল সকালে বর্ণাঢ্য র্যালী, আলোচনা সভা, রক্তদান কর্মসূচী ও লিগ্যাল এইড মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল ৯টায় জেলা জজ আদালত ভবন চত্বরে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হক অন্যান্য অতিথিদের সাথে নিয়ে বেলুন উড়িয়ে ও কবুতর অবমুক্ত করে দিবসের কর্মসূচীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হকের নেতৃত্বে বর্ণাঢ্য র্যালী জেলা জজ আদালত চত্বর থেকে বের হয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে একই স্থানে এসে শেষে হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও র্যালীতে অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসক জিনাত আরা, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল ইসলাম, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আলমগীর কবির, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মানোয়ার হোসেন মোল্লা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এডঃ এম.এ খালেক, সিভিল সার্জনের প্রতিনিধি এমওসিএস ডাঃ কাজী সফিউল আজম, জেলা জজশীপ ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসীর বিচারকগণ, জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী ইরাদত আলী, জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মোঃ ফেরদৌস, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার(ক্রাইম) মোঃ আছাদুজ্জামান, জেলা বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এডঃ গণেশ নারায়ন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এটিএম মোস্তফা মিঠু, পিপি এডঃ উজির আলী শেখ, জিপি এডঃ মোঃ আনোয়ার হোসেনসহ জেলা বারের আইনজীবীগণ, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাগণ, এনজিও প্রতিনিধিগণ ও আমন্ত্রিত অতিথিগণ অংশগ্রহণ করেন।
র্যালী শেষে জেলা জজ আদালত চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হকের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক জিনাত আরা, পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল ইসলাম, চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আলমগীর কবির, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব এডঃ এম.এ খালেক, জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী ইরাদত আলী, জেলা বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এডঃ গণেশ নারায়ন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এটিএম মোস্তফা মিঠু, পিপি এডঃ উজির আলী শেখ, জিপি এডঃ মোঃ আনোয়ার হোসেন, রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি এডঃ খান মোঃ জহুরুল হক, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির প্যানেল আইনজীবী এডঃ পিলা রাণী সেন, এডঃ সৈয়দ মনোয়ারুল হক, জেলা ব্র্যাক প্রতিনিধি নেফাজ উদ্দিন ও লিগ্যাল এইড কার্যক্রম থেকে আইনগত সহায়তাপ্রাপ্ত মোঃ ইব্রাহিম, নূরজাহান বেগম প্রমুখ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য-সচিব, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সহকারী জজ ইসরাত জাহান।
আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান এবং জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হক সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আজ রাজবাড়ীর ন্যায় সারা দেশে “বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়, লিগ্যাল এইড অফিসে আপোষও হয়”-এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে দেশের আইনী সহায়তা থেকে বঞ্চিত অসহায় ও গরীব মানুষকে বিনা খরচে আইনী সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালিত হচ্ছে। আমাদের সকলের জন্যই আজকের এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী দেশের আপামর জনসাধারণকে সরকারী আইনী সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৮শে এপ্রিলকে জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করা হচ্ছে। দেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার ও সমতার এক অনন্য দলিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ১৯, ২৭, ৩১ ও ৩৩ নং অনুচ্ছেদে ন্যায় বিচার ও সার্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিতের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বলতে হয় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার একটি অন্যতম পূর্বশর্ত “একসেস টু জাসটিস” নিশ্চিত করা। কিন্তু দারিদ্র, অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা, বৈষম্য, বঞ্চনা, অনগ্রসরতা ইত্যাদির কারণে সমাজের একটি অংশ ন্যায় বিচারে প্রবেশাধিকার থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের কথা মাথায় রেখেই বাংলাদেশ সরকারের এই লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের সূচনা। সার্বজনীন ও মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইডের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সমকালীন বহিঃবিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায়। গত দশকে পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, যুক্তরাজ্যের বাৎসরিক লিগ্যাল এইড গ্রহীতার সংখ্যা মোট বিচারপ্রার্থীর ১৩ শতাংশ, জার্মানিতে যা ৮শাতংশ। জার্মানিতে লিগ্যাল এইড পাওয়ার অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। আমাদের পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতে প্রতি বছর লিগ্যাল এইড ডে উদযাপন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে “প্রো বোনো” সার্ভিস নামে বিনা পয়সায় আইনজীবী কর্তৃক লিগ্যাল এইড প্রদান করা হয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে লিগ্যাল এইড প্রদানের ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আরো বেশী। আর সেই জন্যই বর্তমান সরকার “আইনগত সহায়তা আইন-২০০০” প্রনয়ণের পর তা কার্যকর করার জন্য ২০০০ সালেই “জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা” নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। প্রত্যেক জেলায় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির মাধ্যমে অর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ব্যক্তিদের সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির পাশাপাশি সারা দেশে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড বিষয়ক উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনে পৃথক লিগ্যাল এইড অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। লিগ্যাল এইড অফিসকে আরো কার্যকর, গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় একটি করে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং একজন সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচারককে উক্ত পদে পদায়ন করা হয়েছে। চলতি বছরে আপোষ-মীমাংসা তথা বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তিকে উপজীব্য করে সরকার জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবসে-২০১৭ এর প্রতিপাদ্যকে নির্ধারণ করেছে।
জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হক রাজবাড়ীর লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে বলেন, রাজবাড়ী জেলায় ২০১৩ সালে আইন সহায়তা প্রাপ্তির জন্য মোট ৩৫৫টি আবেদন জমা পড়ে, এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৮৪টি মোকদ্দমা। ২০১৪ সালে ৪৬২টি আবেদন জমা পড়ে, নিষ্পত্তি হয় ১৫২টি মোকাদ্দমা, ২০১৫ সালে ৪৮২টি আবেদন জমা পড়ে, নিষ্পত্তি হয় ১৫৬টি মোকাদ্দমা, ২০১৬ সালে ২৮৬টি আবেদন জমা পড়ে নিষ্পত্তি হয় ১৪৮টি মোকদ্দমা। সর্বশেষ ২০১৭ সালে চলতি মাস পর্যন্ত মোট আবেদন জমা পড়েছে ৩৩টি আর পূর্বের জেরসহ নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৫টি মোকদ্দমার। বর্তমানে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের চলমান মামলার সংখ্যা ফৌজদারী-৬১৫টি, দেওয়ানী-৪১১টি ও পারিবারিক-৪৭৯টি। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক চিত্র আমাদের আশাবাদী করে কেননা প্রতি বছরই পূর্বের বছরের তুলনায় অধিক সংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে সরকারী আইনী সহায়তা কার্যক্রমের ব্যাপক বিস্তার ঘটলেও এর উৎকর্ষ সাধনের জন্য আরো অনেক সুযোগ বিদ্যমান। বিচারক, আইনজীবী, আদালত সংশ্লি¬ষ্ট সকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিন্তু সম্মিলিত চেষ্টা লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে আরো ব্যাপক গতিশীলতা এনে দিতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দরিদ্র বান্ধব, সমতা ভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক একটি দক্ষ কার্যকর ও আধুনিক লিগ্যাল এইড সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করতে পারব। এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে দিবসটির সকল কার্যক্রমে অংশগ্রহণসহ সফল করার জন্য বিভিন্ন প্রচারণা ও বিভিন্নভাবে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটিকে সহায়তা প্রদান করার জন্য জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, জেলা স্বাস্থ্য বিভাগসহ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
আলোচনা সভায় জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য জেলা প্রশাসক জিনাত আরা বলেন, জাতীয় লিগ্যাল এইড দিবস আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের মাধ্যমে আমাদের দেশের যে সমস্ত সাধারণ অসহায় জনগণ আইনী সেবা থেকে বঞ্চিত তাদের আমরা এই সংস্থার মাধ্যমে বিনা খরচে আইনী সহায়তা প্রদান করতে পারি। সেই জন্যই সরকার আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এই আইনগত সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। আমাদের সকলকে এই জেলার আইনী সহায়তা থেকে বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে এই লিগ্যাল এইড কার্যক্রম সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারনার মাধ্যমে জানাতে হবে। যাতে তারা এই কার্যক্রমের সহায়তা পেতে পারে।
তিনি আরো বলেন, আমরা সকলে যদি এই বিষয়ে উদ্যোগী হই তবে এই জেলায় এই লিগ্যাল এইড কার্যক্রম আরো বেগবান করা সম্ভব হবে । আর এর জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে কোন ধরনের সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কাজী ইরাদত আলী তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাকে বাস্তবে রূপদানের উদ্দেশ্যে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিরলসভাবে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। তার ধারাবাহিকতায় দেশের সাধারণ অসহায় মানুষ যেন বিনা খরচে আইনী সহায়তা পায় সেই লক্ষ্যে তিনি উন্নত বিশ্বের মত আমাদের দেশে লিগ্যাল এইড সংস্থার বা আইনী সহায়তা সংস্থার কার্যক্রম চালু করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি যে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ তারই প্রকাশ পায়। আমরা সকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম আরো বেগবান করার মাধ্যমে জেলার অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষ যেন আইনী সকল সুবিধা পায় সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করব।
আলোচনা সভা শেষে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আমিনুল হক, জেলা প্রশাসক জিনাত আরাসহ আমন্ত্রিত অতিথিগণ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ব্যবস্থাপনায় দিবসটি উপলক্ষে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন। এছাড়া দিবসটি উপলক্ষে আয়োজিত লিগ্যাল এইড মেলায় জেলা লিগ্যাল এইড কর্নার ও এনজিও ব্র্যাকের আইনী সহায়তা কার্যক্রমের স্টল পরিদর্শন করেন।