Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

সাফল্য গাঁথা ঃ ফরিদপুরের অদম্য এক রোকেয়ার গল্প

॥মাহবুব হোসেন পিয়াল॥ চোখে দেখতে পান না। কিন্তু নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় ফরিদপুর সদরের একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে ইতিমধ্যে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি যখন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, তখন তার সহকর্মীরা চিন্তিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, তিনি তো চোখে দেখতে পান না, কি পড়াবেন-কীভাবে নেবেন ক্লাস! কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই তাদের এই ভুল ভাঙ্গে।
রোকেয়া বেগম(২৭) নামের এই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক ফরিদপুর সদর উপজেলার তাম্বুলখানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ২০১৩ সালের ১লা ডিসেম্বর। তিনি বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণী, ৩য় শ্রেণী ও ৪র্থ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ান।
রোকেয়া বেগম বলেন, প্রথম প্রথম আমাকে একটু বেগ পেতে হয়েছিল। শিশুরা আমাকে দেখে ভয় পেত। তবে অল্পদিনের মধ্যেই আমি ওদেরকে আপন করে নিতে পেরেছি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে গান গেয়ে, ছড়া-কবিতা বলে আমি ওদের মন জয় করে নিয়েছি। এখন আমার আর বাড়ীতে সময় কাটতে চায় না। সারা রাত শুধু একটাই চিন্তা হয়-কখন সকাল হবে, কখন স্কুলে যাব।
সম্প্রতি রোকেয়ার ক্লাস নেওয়া দেখতে তাম্বুলখানা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, তিনি শিশু শ্রেণীর ক্লাস নিচ্ছেন। মেঝেতে ম্যাট বিছিয়ে সব শিশু গোল হয়ে রোকেয়াকে ঘিরে বসেছে। রোকেয়া পড়াচ্ছে, স্ব-রে অ-অজগরটি আসছে তেড়ে, স্ব-রে আ-আমটি আমি খাব পেড়ে। কথা শেষ করেই রোকেয়া মাটির তৈরি আম ধরে দেখিয়ে শিশুদের শেখাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রতিশব্দও শেখাচ্ছেন। অ-তে অজগর, আবার অ-তে অলংকার। অলংকার বুঝাতে নিজের গলার মালা, কানের দুল দেখিয়ে শেখাচ্ছেন। আবার রোকেয়া কোন প্রশ্ন করলে শিক্ষার্থীরা সাথে সাথে সমস্বরে উত্তর দিচ্ছে। সব মিলিয়ে এক আনন্দঘন পরিবেশ।
শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরাফাত জানায়, আপা ভালো পড়ায়। আপা বলে যায় আমরা তার সাথে সাথে বলি। একই শ্রেণীর সৃজিত শীল জানায়, আপা গান গেয়ে, ছড়া-কবিতা শুনিয়ে পড়ায়। পড়ানোর সময় বিভিন্ন ছবি দেখায়। তাকে আমাদের খুব ভালো লাগে। ‘পড়া না পারলে শিশুদের মারেন কি’-এ প্রশ্ন করতেই রোকেয়া জিহ্বা বের করে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে ‘না’, ‘না’ ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে বলেন, ‘কেন আমি ওদেরকে মারবো, ওরা তো আমার সন্তানের মত।’
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিউলী দাস বলেন, রোকেয়া যখন এ বিদ্যালয়ে এসে যোগ দেন আমরা তখন বেশ চিন্তিতই হয়ে পড়েছিলাম। তিনি কীভাবে ক্লাস নেবেন, এলাকার লোকজনইবা বিষয়টি কীভাবে দেখবে। পরে তিনি যোগ দেয়ার পর তার দক্ষতা দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই। তিনি অনেক মেধাবী। খুব সহজেই সবকিছু রপ্ত করে নিতে জানেন। আমরা বোঝার আগেই বুঝে যান। দুই মাসের মধ্যেই তিনি আমাদের সবার আপনজন হয়ে উঠেছেন।
আরেক সহকারী শিক্ষক রুমা বর্মন বলেন, আমি আমার ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি রোকেয়াকে সাহায্য করি। শিক্ষার্থীদের হাজিরা দিয়ে দেই। বোর্ডে কিছু লেখার প্রয়োজন হলে লিখে দেই। রোকেয়ার পড়ানোর স্টাইল ও একাগ্রতা দেখলে মনেই হয়না ও দুই চোখে দেখতে পায় না।
প্রধান শিক্ষক কাকলী রানী সাহা বলেন, রোকেয়া মিশুক ও অসাধারণ ভালো মানুষ। জানার স্পৃহা বেশী। স্কুলের সময় দারুণভাবে মেনে চলেন। তিনি ব্রেইল পদ্ধতির বই দিয়ে শিশুদের পাঠ দেন। পাঠদানের প্রতিটি বই রোকেয়াকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বাড়তি খরচ করে সংগ্রহ করতে হয়। এ বিষয়টি সরকারীভাবে দেখা গেলে ভালো হয়। এছাড়া প্রাইমারী শিক্ষকদের যে ট্রেনিং হয় পিটিআইতে সেখানেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা বইয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। কেননা ট্রেনিংয়ের সব বিষয় একবারে মনে থাকার কথা নয়।
ফরিদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ জেলায় নতুন যোগদান করেছি। রোকেয়ার স্কুলটি এখনও আমার ভিজিট করা হয়নি। তাই রোকেয়ার সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই।’ তবে সদ্য বিদায়ী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শিবপদ দে বলেন, ‘রোকেয়ার পারফরমেন্স খুব ভালো। গান গেয়ে হাততালি দিয়ে পড়িয়ে ক্লাস মাতিয়ে রাখে। ওর জন্য যাতে ব্রেইল পদ্ধতির বই সরকারীভাবে সরবরাহ করা যায় সে চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া পিটিআইয়ের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বই সংযুক্ত করার জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমীতে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ইতিমধ্যে রোকেয়া প্রথমে ফরিদপুর জেলায়, পরে ঢাকা বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জয়ীতার সম্মাননা (মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের দেয়া) পেয়েছে।’
ফরিদপুর সদরের তাম্বুলখানা এলাকারই সন্তান রোকেয়া বেগমের জন্ম ১৯৯২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর। তার বাবা মুজিবুর রহমান মারা যান ১৯৯৫ সালে। তার দুই বছর পর মারা যান মা হাসিনা বেগম। ৫ বোন ও ১ ভাইয়ের মধ্যে রোকেয়া ৪র্থ। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর বড় বোন শাহানাজ বেগম(৪৩) রোকেয়াসহ অন্য ভাই-বোনদের দায়িত্ব নেন। দ্বিতীয় বোন মর্জিনা আক্তারের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র ভাই রফিক শেখ(২৩) পড়াশোনা করেনি। রোকেয়া বেগম ছাড়াও তার ৩য় বোন শিখা ও ছোট বোন আছিয়া পড়াশোনা করছেন। শিখা ঢাকার ইডেন কলেজে সমাজবিদ্যা বিষয়ে মাস্টার্স এবং আছিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ থেকে মাস্টার্স করছেন। ৬ভাই-বোনের মধ্যে পড়াশোনা করেছেন রোকেয়া, শিখা ও আছিয়া। এই ৩ বোনই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তবে তাদের প্রতিবন্ধীতা জন্মগত নয়। রোকেয়ার ৪ বছর, শিখা ৯ বছর ও আছিয়া ৭বছর বয়সে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। ২০০০ সালে ঢাকার ইসলামিয়া হাসপাতালে এই ৩ বোন চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, তাদের মা ও বাবা খালাতো ভাই-বোন হওয়ায় রক্তের কারণে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এই রোগ নিরাময়যোগ্য নয়। ফরিদপুর মুসলিম মিশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এম.এ সামাদের সহযোগিতায় এই ৩ বোন ঢাকার মিরপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন ইন্টিগ্রেটেড স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে তারা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। রোকেয়া ওই মিশনের হোস্টেলে থেকেই মিরপুর আইডিয়াল স্কুল ও কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ঢাকার বদরুননেসা সরকারী মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ইডেন কলেজে ডিগ্রীতে ভর্তি হন। কিন্তু এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় শ্রুতি লেখকের মাধ্যমে অংশ নিয়ে সহকারী শিক্ষক পদে এই চাকরী পান।