Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

পাংশা উপজেলা চেয়ারম্যান ওদুদ মন্ডলের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করলেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার

॥স্টাফ রিপোর্টার॥ রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক ফরিদ হাসান ওদুদের বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদের সরকারী জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ তদন্ত গতকাল ১০ই জানুয়ারী বেলা ১১টায় অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কে.এম আলী আজম পাংশা উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে এই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এ সময় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের ডিএলজি (যুগ্ম-সচিব) ইদ্রিস আলী, জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী ও পাংশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
তদন্তকালে বিভাগীয় কমিশনার পাংশা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদের বিরুদ্ধে পরিষদের সরকারী জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাগজপত্র দেখেন এবং পাংশা পৌরসভার মেয়র ও পাংশা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণসহ অভিযোগকারীদের বক্তব্য শোনেন ও তাদের লিখিত স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এরপর তিনি অভিযুক্ত পাংশা উপজেলা চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদের বক্তব্য শোনেন।
তদন্ত কার্যক্রমের শেষে বিভাগীয় কমিশনার কে.এম আলী আজম উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে বিভিন্ন উপজেলা পরিদর্শন করা আমার নিয়মিত কার্যক্রমের একটি অংশ। তারই প্রেক্ষিতে আমি আজ পাংশা উপজেলা পরিষদ পরিদর্শনসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিদর্শনের পাশাপাশি পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করতে এসেছি। ইতিমধ্যে আমি আমার তদন্ত কাজ শেষ করেছি। তদন্তে যা পেয়েছি সেগুলো আমি প্রতিবেদন আকারে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেব।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার আরো বলেন, আজকে আমি মূলত পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পরিষদের জমি অবৈধভাবে দখল, নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির তদন্ত করেছি। পাংশা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, অভিযুক্ত উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, উপজেলা সমাজসেবা অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাতকার নিয়েছি এবং তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছি। আমরা সকল কিছু বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে যথাসময়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন আকারে জমা দেব। এছাড়াও এই দুর্নীতি তদন্তের পর পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্বপদে বহাল থাকবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার কেবল তদন্ত শুরু করেছি। সে কারণে ব্যবস্থা গ্রহণের পর্যায় এখনও আসেনি।
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর বিভাগীয় কমিশনার সরেজমিনে পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ কর্তৃক পাংশা বাজারে উপজেলা পরিষদের জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত শেড ও দোকান পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তিনি বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেন।
বিভাগীয় কমিশনারের নিকট স্বাক্ষ্য প্রদানকারী কলিমহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পাংশা বাজারের জমি যেভাবে নিজের আত্¥ীয়-স্বজনের নামে লিখে নিয়েছেন তা নজির বিহীন। দুুর্নীতির বিষয়গুলো আমরা ৯জন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিখিতভাবে দিয়েছি। শুধুমাত্র তার ভাই যশাই ইউপির চেয়ারম্যান তার পক্ষে বলেছে।
পাংশা মাছ বাজার ও কাঁচা বাজারের সভাপতি মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান তার আত্মীয় গার্লস কলেজের অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে অবৈধভাবে দোকান দিয়েছেন। অথচ তিনি কোন ব্যবসায়ী নন।
এ বিষয়ে পাংশা আইডিয়াল গার্লস কলেজের অধ্যাপক মোঃ আব্দুল মান্নান জানান, পাংশা বাজারের জমির একটি অংশ পার্টনার হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যান তাকে দিয়েছেন।
অভিযাগকারী পাংশা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সী বলেন, চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ বিধি বহির্র্ভূতভাবে উপজেলা পরিষদের জায়গায় মার্কেট করে আত্মীয়-স্বজনসহ ১০০টির উপরের দোকান বরাদ্দ দিলেও পরিষদের রেজুুলেশনে উল্লেখ আছে মাত্র ১৩টির। এছাড়াও তিনি অনেক দুর্নীতি-অনিয়ম করেছেন। তাই অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছি। আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।
পাংশা পৌরসভার মেয়র আব্দুল আল মাসুদ বিশ্বাস বলেন, চেয়ারম্যানের দুর্নীতির বিষয়ে আমরা সঠিক যেটা জানি তা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে তুলে ধরেছি। চেয়ারম্যান মিথ্যাচার করে বেড়াচ্ছেন যে, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা মিলে নাকি দোকান বিক্রি করেছি। তার ভাই মোঃ আব্দুল ওয়াজেদ মন্ডল মেয়র থাকার সময় দু’জনে মিলে বাজারের অন্তত ৩ কোটি টাকার প্রোপার্টি বিক্রি করে আত্মসাত করেছে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
এছাড়াও বিভাগীয় কমিশনারের তদন্তকালে পাংশা পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ কর্তৃক পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে দোকান বরাদ্দ সংক্রান্তে মিথ্যাচারের লিখিত একটি অভিযোগ দেয়া হয়।
উক্ত অভিযোগে বলা হয়, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তার অপকর্ম ও দুর্নীতি ঢাকার জন্য দোকান বরাদ্দ সংক্রান্তে মিথ্যাচার করে পৌরসভার সুনাম ক্ষুণœ করছেন। তবে লোক মুখে শোনা যায় পাংশা পৌরসভার সাবেক মেয়র(উপজেলা চেয়ারম্যান ওদুদের সহোদর) ওয়াজেদ আলী মন্ডল একক ভাবে অর্থের বিনিময়ে উক্ত দোকানের বরাদ্দ প্রদান করেছেন।
অভিযোগের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ফরিদ হাসান ওদুদ কোন কথা বলতে রাজী হননি।
উল্লেখ্য,  পাংশা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ হেনা মুন্সীর গত ২৩/০৪/২০১৮ ইং তারিখের পত্রের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৭/০৫/২০১৮ইং তারিখে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করে। এর আগে প্রথমে গত ১৪/১১/২০১৮ তারিখে উক্ত অভিযোগ তদন্তের জন্য বিভাগীয় কমিশনার কর্তৃক দিন ধার্য্য করা হয়েছিল। কিন্তু পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ কর্তৃক তদন্ত কার্যক্রম একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে করার জন্য আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক তদন্ত কার্যক্রমটি ৩১/০১/২০১৯ইং পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব বরাবর ভাইস চেয়ারম্যানের দাখিলকৃত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা/২০১৪ অনুসরণ না করে বিধি বহির্ভুতভাবে উপজেলা পরিষদের তহবিল ব্যবহার করে সরকারী জমিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণসহ নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে যাচ্ছেন। সাধারণত উপজেলা পরিষদের জমিতে কোন স্থাপনা নির্মাণ করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয় এবং জেলা প্রশাসকের অনুমোদনসহ উপজেলা পরিষদের সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান এ সকল প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পাংশা বাজারে পরিষদের জমিতে শেড, দোকান ঘর নির্মাণ করে অবৈধভাবে বরাদ্দের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ইতিপূর্বে পরিষদের সভায় আলোচনা ছাড়াই রেজুলেশনের মধ্যে বাজারের ঐ জমিতে একটি সেড নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঢুকিয়ে দেন এবং সেখানে ৫লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেখিয়ে তার চাচাতো ভাইকে ঐ কাজের কার্যাদেশ প্রদান করেন। এরপর তিনি একের পর এক শেড ও দোকান নির্মাণে উপজেলা পরিষদের কোন অনুমোদন নেননি। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের গোচরীভূত হলে মাসিক সভায় দোকান বরাদ্দ বিষয়ে তদন্তের জন্য ৫সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং অবৈধ স্থাপনার সকল কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনি উপজেলা পরিষদের জায়গায় নিয়ম বহির্ভুতভাবে ১৩টি দোকান নিজের আপন ভাই, চাচাতো ভাই, আত্মীয়-স্বজন ও উপজেলা পরিষদের কর্মচারীদের মধ্যে বরাদ্দ প্রদান করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। যা উপজেলা পরিষদের সম্পত্তি অস্থায়ী ভিত্তিতে হস্তান্তর বিধিমালা ২০০৬/২৪ আইন এর পরিপন্থী। এছাড়াও তিনি গরীব ও মেধামী ছাত্র/ছাত্রীদের উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা অনুসরণ না করে নিজেস্ব লোকদের সন্তানদের মধ্যে তহবিল থেকে বৃত্তি প্রদান, পাংশা উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নিকট থেকে উপজেলা পরিষদের ১% তহবিল টাকা হতে ১লক্ষ টাকার বিনিময় ১লক্ষ টাকা প্রদান, বয়স্ক ভাতা কর্মসূচী বাস্তবায়ন নীতিমালা (সংশোধিত) ২০১৩ অনুসরণ না করে বিধি বহির্ভূতভাবে বয়স্ক ভাতা প্রদান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে রাজস্ব ফান্ড ব্যবহার করে এসি ও আইপিএস সংযোজন এবং এর বিদ্যুৎ বিল প্রদান, স্থানীয় সরকার বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে পৌরসভা এলাকার মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করে উপজেলা পরিষদের এডিপি ফান্ডের বরাদ্দ গ্রহণ ও বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা করছেন।