জিনাত আরা আহমেদ # সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)’র তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা হলো সুস্বাস্থ্য, অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করা ও সব বয়সী মানুষের কল্যাণে কাজ করা। কিন্তু বর্তমানে সুস্থ মানুষ পাওয়া কঠিন। দেখা যায়, স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রায়ই ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে। এসবের কারণ খুঁজলে দেখা যাবে, মূলত আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এর জন্য দায়ী। আমাদের বেশীরভাগই শারীরিক সুস্থতা নিয়ে সচেতন নয়। কোন খাবার আমাদের জন্য ক্ষতিকর, কোনটাতে শরীরের কি ক্ষতি হচ্ছে তার কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই। যেন শুধু স্বাদের জন্য আমরা খাবার গ্রহণ করি। অথচ খাবারের মূল উদ্দেশ্য হলো সুস্থভাবে বেঁচে থাকা। সুস্থতার অন্যতম প্রতিবন্ধক খাবারে মাত্রাতিরিক্ত লবণের ব্যবহার। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে লবণের পরিমিত ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে।
খাবারে অপরিমিত লবণের ব্যবহার আমাদের সুস্থতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। লবণ খাবারের স্বাদকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আকর্ষণীয় খাবার যেমন- ফাস্টফুড, চটপটি, কেচাপ, সস, আচার, নানা ধরনের মশলাযুক্ত খাবারে লবণ হলো প্রধানতম আকর্ষণ। আমাদের দেশের রান্নায় তেল, মশলা এবং লবণ যেন অপরিহার্য উপাদান। শৈশব থেকেই আমরা এ জাতীয় রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যাই। খাবারে লবণের ব্যবহারতো আছেই, তারপর অনেকের আবার কাঁচা লবণ খাওয়ার অভ্যাস থাকে। এছাড়া সালাদ, আচার এসব খাবারের মাধ্যমেও কাঁচা লবণ খাওয়া হয়।
ফাস্ট ফুডের প্রতি আকর্ষণ স্বাস্থ্যের জন্য আরেক শঙ্কাজনক ইঙ্গিত। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা বেশী মাত্রায় ফাস্টফুডের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এতে ব্যবহার হচ্ছে চর্বি জাতীয় তেল, মশলা এবং সেই সাথে লবণ ও টেস্টিং সল্ট, খাবারকে সুস্বাদু এবং আকর্ষণীয় করতে যার জুড়ি নেই। অথচ এটা হৃদরোগের জন্য বেশ ক্ষতিকর। বর্তমান প্রজন্মের কর্মক্ষমতা এবং দীর্ঘ জীবন নিশ্চিত করতে লবণের সীমিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। সারা দিনে চা চামচের এক চামচ পরিমাণ লবণ আমাদের জন্য যথার্থ। এর বেশী হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা হয়। উচ্চ লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করলে পাকস্থলীর ক্যান্সার এবং কিডনীর রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম নির্গমন বাড়িয়ে দেয়। ফলে আমাদের হাড়ের ক্যালসিয়াম ক্ষয়ে হাড় পাতলা হয়ে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই পাতলা হাড়গুলোর ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়, যা ভেঙে গেলে জোড়া লাগতে অনেক সময় লাগে। এছাড়া অতিরিক্ত লবণ গ্রহণে শারীরিক স্থুলতা এবং স্মৃতিবিভ্রাটের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করার ফলে রক্তচাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনী রোগের প্রধান কারণ। হৃদরোগ এবং স্ট্রোক সারা বিশ্বে এক ঘাতক ব্যাধি। বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৭১ লক্ষ লোক এই রোগে মারা যায়। বাংলাদেশের এক চতুর্থাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনী রোগ, পক্ষাঘাত, অন্ধত্বসহ নানা ধরনের জটিল অসুখের জন্য উচ্চ রক্তচাপ বড় ধরনের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে।
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের ফলে আমাদের রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনী ফেইলিয়র এবং হার্ট ফেইলিয়রের ঝুঁকি বেড়ে যায়। প্রাপ্ত বয়স্কদের শারীরিক অক্ষমতা এবং পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ স্ট্রোক এবং হৃদরোগ। উচ্চ রক্তচাপের কারণে শতকরা ৩৯ ভাগ ক্ষেত্রে করোনারী হৃদরোগ এবং ৬১ ভাগ ক্ষেত্রে স্ট্রোক হয়ে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হার্টের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে। বিশ্বের যেসব জনগোষ্ঠী লবণ কম খায় তাদের শতকরা ৮০ ভাগের উচ্চ রক্তচাপ থাকে না। লবণ কম গ্রহণ করলে বৃদ্ধ বয়সে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কমে যায়।
ঘরে-বাইরে উচ্চ লবণযুক্ত খাবার পরিহার করতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। রান্না করার সময় খাবারে অল্প লবণ ব্যবহার করতে হবে। খাবারের সাথে একেবারেই বাড়তি লবণ খাওয়া যাবে না। ফাস্টফুড, রেস্টুরেন্ট ও ক্যান্টিনের খাবারে প্রচুর লবণ থাকে, এজন্য এসব খাবার যথাসম্ভব বাদ দিতে হবে। টিনজাত স্যুপ, সবজি, মাছ, মাংস এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার, পনির যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা উচিৎ। খাদ্য সংরক্ষণ করার জন্য লেবুর রস, ভিনেগার, কাঁচা রসুন, মসলা ব্যবহার করা যেতে পারে। খাবারকে সুস্বাদু করার জন্য বিভিন্ন জিনিস যেমন-কেচাপ, সয়াসস, সালাদ জাতীয় উপকরণ কম ব্যবহার করলে লবণ কম খাওয়া হবে। শুঁটকি মাছ, আচার জাতীয় খাবার কম খান। লবণবিহীন ক্র্যাকার্স, পপকর্ণ এবং বাদাম খাওয়া যেতে পারে। কাঁচা ফলমূল, শাক-সবজি খাওয়ার সময় লবণ পরিহার করতে হবে। একেবারে কম লবণ দিয়ে সম্ভব হলে বাড়ীতেই সস, কেচাপ, আচার, সালাদ বা অন্যান্য খাবার তৈরি করতে পারলে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা সম্ভব। – পিআইডি প্রবন্ধ।