Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারনার শিকার বালিয়াকান্দির বহু পরিবার॥দালাল চক্র তৎপর

॥দেবাশীষ বিশ্বাস॥ বেশী বেতনের চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাঠানোর নাম করে নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সম্পদের মালিক হচ্ছে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার দালাল চক্র।
নিজেদের অবস্থার উন্নতি করলেও অসংখ্য পরিবার ওই প্রতারক চক্রের শিকার হয়ে নিঃস্ব অবস্থায় জীবন-যাপন করছে। ধার-দেনা করে বিদেশে যাওয়ার পর কাজ না পেয়ে ফিরে এসে দেনা শোধের জন্য বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে নিজের ভিটে-মাটি। এরমধ্যে কাতার থেকে ফিরে আসা শ্রমিকদের সংখ্যাই বেশী। দেনা পরিশোধ না করতে পারায় তাদের অনেকেরই ভিটে-মাটি ছাড়া হওয়ার উপক্রম। বিদেশ থেকে ফিরে এসে কাছে প্রতারিত হওয়ার কথা বলতে গেলেই দালাল চক্র উল্টো হুমকি দিচ্ছে। ঘটাচ্ছে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা। বিচার না হওয়ায় দালালদের দৌরাত্মে প্রতারিতরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, বালিয়াকান্দি উপজেলার কয়েকশত যুবক ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কাতার যায়। উচ্চ বেতনের আশায় দালাল চক্রের মাধ্যমে ফ্রি ভিসায় কাতায় গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর দিন-যাপন করে সেখানে। বিদেশেও রয়েছে দালালদের দৌরাত্ম। মাঝে মাঝে বিদেশে কাজ পেলেও সেই টাকাও চলে যায় দালালদের স্বজনদের পকেটে। দেশ থেকে ধার-দেনা আর সহায়-সম্বল বিক্রি করে দেনার চাপে দিশেহারা হয়ে যায় পরিবারগুলো। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে কাতার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কয়েক যুবক। পরে আবার স্বজনরা ধার-দেনা করে দেশ থেকে টাকা পাঠিয়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনে। দেশে ফেরার পর দালালদের কাছে প্রতারনার কথা বলতে গেলেই হুমকির মুখে পড়ছে এসব পরিবার।
২০১৭ সালে ১৪ই জুন জামালপুর ইউনিয়নে বিদেশ ফেরত যুবক ছলিম শেখের টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে দালাল চক্র তার পিতা আদেল উদ্দিন শেখ(৫২)কে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন ১৫ই জুন দালাল চক্রের বাড়ীর পাশে বৃ-মাগুরা এলাকার মতিয়ার মাস্টারের মেহগনি বাগানের একটি রেইনট্রি কড়ই গাছের সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় তার ঝুলন্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়।
এ ঘটনায় নিহতের পুত্র ছলিম শেখ বাদী হয়ে বালিয়াকান্দি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। বালিয়াকান্দি থানার মামলা নং-৭, তাং-১৫/০৬/২০১৭ইং। মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ দালাল চক্রের সদস্য বৃ-মাগুরা গ্রামের মৃত ইবাদত মোল্লার পুত্র মজিবর মোল্লা (৫০)কে গ্রেফতার করে।
মামলায় বাদী ছলিম শেখ উল্লেখ করে, বৃ-মাগুরা গ্রামের মজিবর মোল্লা তাকে(ছলিম শেখকে) ঘটনার ২মাস পূর্বে ৬লক্ষ টাকার বিনিময়ে ভালো বেতনে চাকুরীর কথা বলে কাতারে পাঠায়। সেখানে গিয়ে কোন কাজ না পেয়ে ১মাস পর দেশে ফেরত চলে আসে। দেশে আসার পর মজিবরকে টাকা ফেরত দিতে কিংবা অন্য কোন দেশে পাঠাতে বললে সে টাকা ফেরত বা বিদেশে না পাঠিয়ে ঘুরাতে থাকে। গত ২৭/০৫/২০১৭ইং তারিখে এ বিষয়ে বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ একটি শালিস করে। শালিসের পরও সে টাকা ফেরত দিতে অস্বীকার করে এবং পারলে তার নিকট থেকে উঠিয়ে নিতে বলে। পরবর্তীতে স্থানীয় ওয়ার্ড সদস্য উক্ত বিষয়ে সুরাহা করার জন্য দুই পক্ষের সাথে বসে আলোচনা করে। সেই মোতাবেক গত ১৪ই জুন টাকা দিবে বলে ছলিম শেখের পিতা আদিল উদ্দিন শেখকে জানায়। তার পিতা আদিল উদ্দিন শেখ টাকা আনতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।
আদেল শেখের মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ হত্যাকান্ড বললেও ময়না তদন্তে আত্মহত্যা উঠে আসলে আরো বৃদ্ধি পায় দালাল চক্রের দৌরাত্ম। চলতি বছরের শুরুতে বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে বাড়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয় জালাল নামের এক যুবক। ৩দিন পর তার লাশ পাওয়া যায় বাড়ীর পাশে ডোবায়।
কাতার থেকে প্রতারিত হয়ে দেশে ফিসে আসা জামালপুর ইউনিয়নের আসিফ শেখ জানায়, দালালের মাধ্যমে কাতায় গিয়ে কাজ না পেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। অনেক সময় কাজ পেলেও টাকা চলে যায় দালালদের পকেটে। দালালদের বিরুদ্ধে কয়েকবার স্থানীয় শালিস হলেও টাকা ফেরৎ পাওয়া যায় নাই।
বিদেশে কাজ না পেয়ে ফিরে আসা শ্রমিক সান্টু শেখ জানায়, ৫০/৬০ হাজার টাকা বেতনের কথা শুনে সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা খরচ করে দালালদের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। কাতারে কাজ না পেয়ে ফিরে আসা শ্রমিক পিন্টু মোল্যা জানায়, আমরা একসাথে ১০জন কাতার গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ৯জনই কাজ না পেয়ে ফিরে এসেছি।
ফিরে আসা শ্রমিকদের অভিভাবকেরা জানায়, কাতারের কথা বলেই বালিয়াকান্দিতে বেশী প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। একবার ধার-দেনা করে বিদেশে যাওয়ার পর কাজ না পেয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেখানে জেল খাটার ভয়ে আবারও ধার-দেনা করে ফিরে আসতে হয়েছে।
আজিমুদ্দিন শেখ জানায়, বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে ঋণ, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার, জমি-জমা বিক্রি ও স্থানীয় সুদে ব্যবসায়ীরদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সাড়ে ৫লক্ষ টাকা দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে বর্তমানে ৮লক্ষ টাকা দেনা হয়েছি। ভিটেমাটি বিক্রি করা ছাড়া এখন এই দেনা পরিশোধের মতো আর কোন অবস্থা নেই।
নিহত আদেল উদ্দিনের স্ত্রী জানায়, তার স্বামীর হত্যার পরও পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দেয়ায় এখন বড় ছেড়ে পলাতক। ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে কোনভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করছি। আদেল শেখের বিষয়ে পুলিশ এবং ডাক্তারদের মধ্যে ভিন্নমত আসায় পরিবারের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
ময়না তদন্তে ডাক্তারী প্রতিবেদনে দেখা যায়, আত্মহত্যা কিন্তু পুলিশ বলছে এখানে সুরতহাল প্রতিবেদনকে আমলে না নিয়ে ডাক্তার প্রতিবেদন তৈরী করেছে।
সম্প্রতি বিদেশে প্রতারনার শিকার হয়ে টাকা চাইতে গেলে হত্যার অভিযোগ এবং বিদেশে যাওয়ার কথা বলে বের হওয়ার পর বাড়ীর পাশের ডোবায় লাশ পাওয়া নিয়ে উঠে আসে দালাল চক্রের হাতে খুন হওয়ার বিষয়।
আদেল উদ্দিনের হত্যাকান্ড নিয়ে বালিয়াকান্দি থানার সাবেক এস.আই অলোক কুমার সেন জানান, সুরতহাল প্রতিবেদনে হত্যার পক্ষে আমার মতামত ছিল। ডাক্তাররা ময়না তদন্তে সুরতহাল প্রতিবেদন বিবেচনা করলেও আদেলের ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। আমি নিশ্চিত এটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা। তাকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ রহিম বক্স বলেন, আদেল উদ্দিন নিজেই গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার করার তথ্য ময়না তদন্তে উঠে এসেছে।
পুলিশ ও ময়না তদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী এডঃ কে.এ বারী জানান, সিআইডি পুনরায় ময়না তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করলে আদালত সে আবেদন না মঞ্জুর করে। তিনি বলেন, সিআইডির চুড়ান্ত প্রতিবেদন এলে নারাজী দিয়ে পুনরায় ময়না তদন্ত চাইবো।
এ ব্যাপারে সিআইডির রাজবাড়ী ক্যাম্পের পরিদর্শক শেখ মোঃ আক্তারুজ্জামন বলেন, ডাক্তারী প্রতিবেদনের উপর আমাদের কিছু বলার নেই। তবে থানা পুলিশের কাছ থেকে মামলা সিআইডিতে আসলে আমরা পুনরায় ময়না তদন্ত চাইলে আদালত সেটা না মঞ্জুর করে।
প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে কাজ করা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান জানান, রাজবাড়ীর ৫টি উপজেলার মধ্যে বালিয়াকান্দিতে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতারনার হার বেশী। বিদেশে যারা যাচ্ছে তারা কোথায় যাচ্ছে এবং কার মাধ্যমে যাচ্ছে সেটা নিশ্চিত হওয়া জরুরী। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন সচেতনতা তৈরী ও পরামর্শ প্রদান করছে। কেউ বিদেশে যাওয়ার পূর্বে কার মাধ্যমে যাচ্ছে সেটা ভালভাবে যাচাই করার জন্য উপজেলা প্রশাসন অথবা জেলা প্রশাসন থেকে সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই করতে পারে।
প্রতারনার বিষয়ে বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিসদের চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, গত ৫বছরে বিদেশে প্রতারনা সংক্রান্ত শতাধিক শালিস করে টাকা আদায় করে দিয়েছি। বালিয়াকান্দিতে দালাল চক্র ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যে কারণে পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে। প্রতারক চক্র বুঝেছে ৫লক্ষ টাকা নিয়ে ২লক্ষ টাকা ফেরত দিলেও ৩লক্ষ টাকা লাভ থাকে। যে কারণে প্রতারক চক্র আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে ।
অনুসন্ধানে বাহার সত্তার, মজিবর রহমান ভুলে, মিজানুর রহমান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য দালালের নাম পাওয়া গেছে।