॥রঘুনন্দন সিকদার॥ যে নদীর বুক দিয়ে একসময় চলত সারি সারি নৌকা, সেই খরস্রোতা নদীগুলোই এখন যৌবন হারিয়ে পানির অভাবে মৃত। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলোর অস্তিত্ব।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ইচ্ছামত পানি প্রত্যাহার, জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের অবৈধ দখল ও ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহোৎসব দিন দিন গ্রাস করছে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার এক সময়ের বহমান প্রমত্তা গড়াই, চন্দনা, হড়াই, চত্রা ও পুষস্বলী নদীকে।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বর্তমানে এই ৫টি নদী নাব্যতা হারিয়ে ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। এখন এই নদীগুলো যেন শুধুই ইতিহাস। ১৯৭৫ সালে ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ চালু করার পর মরণদশা শুরু হয়েছে বালিয়াকান্দির উপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদীগুলোর।
নদী আছে, পানি নেই। প্রতি বছর বালু জমতে জমতে নদীগুলোর বুক এখন বিশাল বালুচরে পরিণত হয়েছে। এবারের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বিগত বছরগুলোয় গড়াই নদীতে একটা ক্ষীণ স্রোতধারা থাকলেও এবার তাও নেই। ফলে এই নদীটি এখন মৃত খালে পরিণত হয়েছে। নদীতে পানি না থাকায় এ অঞ্চলের পরিবেশ এবং কৃষক ও জেলেদের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে বিপর্যয়। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে মরণবাঁধ ফারাক্কা।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে ফারাক্কা বাঁধ এ অঞ্চলের মানুষের জন্য রীতিমত অভিশাপ বয়ে এনেছে। একতরফা পানি প্রত্যাহার করে ভারত তাদের বন্দর, কৃষি, সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা সচল রাখলেও এদেশের কৃষি, বন্দর, নৌ-যোগাযোগ, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
বালিয়াকান্দির এই নদীগুলোর উৎসমুখ পদ্মা নদীতে হওয়ায় আজ মানচিত্র থেকে পদ্মার সাথে সাথে এর শাখা নদী গড়াই, চন্দনা, হড়াই, চত্রা ও পুষস্বলী নদীও হারিয়ে যাচ্ছে। নদীগুলোতে বারো মাসই পানি শূন্য থাকায় এ অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বর্ষাকালে এসব নদীতে কিছু দিনের জন্য পানি থাকলেও প্রায় সারা বছরই থাকে পানি শূণ্য। আর পানি শূণ্য থাকায় স্থানীয় একশ্রেণীর প্রভাবশালী দখলদাররা নদীর দু’পাশ দখল করে নিয়েছে। চন্দনা নদীর দু’পাশেই রয়েছে অবৈধ দখলদার।
স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও তা কোনই কাজে আসছেনা। অন্য দিকে হড়াই, চত্রা ও পুষস্বলী নদীর বুকে জেগে উঠা চরে এখন স্থানীয় কৃষকেরা ধানসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গড়াই ও চন্দনা নদীতে মাইলের পর মাইল জেগে উঠেছে বিশাল আকৃতির বালুচর। নদীতে নেই কোন স্রোত, নেই কোন গভীরতা। অনেক জায়গায় নদীগুলোর বুক দিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বালু বোঝাই ট্রাক ও ট্রলি। অনেক কৃষক আবার জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন ফসলের চাষ করছে। শুধু দেখা মেলেনি নদীতে মাছ ধরার সারি সারি নৌকা ও জেলেদের জাল। নদীগুলো মরে যাওয়ায় আজ এ অঞ্চলের কৃষি, বাণিজ্য, মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশ হয়েছে বিপন্ন। হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির অর্ধশতাধিক মাছ। কৃষি ও মৎস্যজীবীরা আজ মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকাশ কৃষ্ণ সরকার জানান, সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গঙ্গা ব্যারেজ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যেটির স্থান প্রাথমিকভাবে জেলার পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে নির্ধারণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রজেক্টের স্ট্যাডিসহ কিছুটা কাজও হয়েছে। টেকনিক্যাল কারণে বর্তমানে প্রজেক্টটি স্থগিত রয়েছে। এ প্রকল্পটি চালু হলে পদ্মার সাথে সম্পৃক্ত সব শাখা নদী ফিরে পাবে তাদের অতীত যৌবন। ব্যাপক উন্নয়ন হবে এ অঞ্চলের মৎস্য ও কৃষি অর্থনীতিতে। তাছাড়া বালিয়াকান্দির উপর দিয়ে প্রবাহিত গড়াই নদীসহ সব নদীগুলো খনন করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
নারুয়া লিয়াকত আলী স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক বদিউজ্জামান জানান, আন্তর্জাতিক নদীগুলোর সুষ্ঠু পানিবন্টন ব্যবস্থাপনা না থাকা এবং ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাবের কারণেই আজ এই নদীগুলো মরে যাচ্ছে। নদীগুলোকে আবার পুনরুজ্জীবিত করতে হলে দ্রুত খনন কাজ শুরু করতে হবে। সেই সাথে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাসুম রেজা জানান, জেগে ওঠা নদীর দুই পাশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ এবং বালু উত্তোলন বন্ধে বিশেষ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নদীগুলো যাতে দখল না হতে পারে সে জন্য আমরা সজাগ রয়েছি।
বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমান সরকার মৃত নদীগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ইতিমধ্যে বালিয়াকান্দির চন্দনা নদীটি পুনঃখনন করা হয়েছে। গড়াই নদীর খনন কাজটি কুষ্টিয়া থেকে শুরু হয়েছে। আশা করছি এদিকে খনন কাজ শুরু করলে নদীগুলো আবার জেগে উঠবে।