Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় : জরিমানাসহ খালেদা জিয়ার ৫বছর-তারেকসহ অন্যদের ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ড

॥স্টাফ রিপোর্টার॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ৫বছর ও তার পুত্র দলটির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর পাঁচ আসামীর ১০বছর করে কারাদন্ড দিয়ে গতকাল ৮ই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায় দিয়েছে ঢাকার বিশেষ আদালত-৫।রাজধানীর বকশিবাজারের উমেশ দত্ত রোডের কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ড মাঠে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান জনাকীর্ণ আদালতে গতকাল ৮ই জানুয়ারী এ রায় ঘোষণা করেন। ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার ১৫মিনিট পড়েন বিচারক ড. আখতারুজ্জামান।
রায়ে বলা হয়, মামলার অপরাধ সন্দোহীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সামাজিক মর্যাদা ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ৫বছর কারাদন্ড দেয়া হয়। এ মামলায় অপর আসামী তার পুত্র বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড দেয় আদালত। সেই সঙ্গে তাদের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।
আসামীদের মধ্যে এর আগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের এক মামলায় ৭বছরের সাজা দিয়েছে হাইকোর্ট। তিনি পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়াও গতকাল দন্ডিত ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমানও পলাতক রয়েছেন। এ মামলার আসামী কারাগারে থাকা কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিনকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। সাজা ঘোষণার পর আবারও তাদের কারাগারে ফিরিয়ে নেয়া হয়।
রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আসামীপক্ষের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত এ রায় দেয়। তিনি বলেন, আসামীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎসহ আনীত অভিযোগ ৩২জন সাক্ষি ও অন্যান্য তথ্য প্রমাণ দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে দুদক প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন তিনি।
খালেদা জিয়ার পক্ষে তার আইনজীবী প্যানেলের সদস্য ব্যারিষ্টার এএম মাহমুব উদ্দিন খোকন সাংবাদিকদের বলেন, রায়ে বেগম খালেদা জিয়া সংক্ষদ্ধ। তিনি আমাদের আপিল দায়েরের প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির অপরাধে দন্ডিত হলেন। এরআগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত হন। তিনি সাজাও খাটেন।
বেলা সোয়া ২টায় এ দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা শুরু করে বিচারক। বেলা পৌনে দুইটার দিকে আদালতে বিচারকের ডায়াসের খুব কাছের একটি চেয়ারে বসেন ঘিয়ে রঙের শিফন শাড়ি পরা খালেদা জিয়া। এ সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত তিনি তার দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। রায় ঘোষণাকালীন প্রথমে তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। রায়ের পরপর তাকে কারাগারে নেয়ার সময় তিনি স্বাভাবিক ছিলেন।
রায়ের সময় বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর(অবঃ ) হাফিজ উদ্দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
মামলায় আসামীপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এডভোকেট আবদুর রেজাক খান, এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, এডভোকেট সানা উল্লাহ মিয়া প্রমুখ।
অন্যদিকে দুদকের পক্ষে আইনজীবী প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল, মীর আহমেদ আলী সালাম ও মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর এবং ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন।
এ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আদালতসহ আশপাশ এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রহণ করা হয়। আদালতে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।
রায়ের পরপরই বেলা ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে বেগম খালেদা জিয়াকে নেয়া হয় পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার ভবনে। কারাগার ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারাগারের চারদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও অবস্থান জোরদার করা হয়েছে।
গত ২৫শে জানুয়ারি এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করে আদেশ দেয় বিচারিক আদালত। এরআগে এ মামলায় ২৩৬ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে ৩২জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ-জেরা এবং ২৮কার্য দিবস আত্মপক্ষ সমর্থন ও ১৬ কার্য দিবস যুক্তিতর্ক শুনানি অনুষ্টিত হয়।
এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে জিয়া অরফানেজ মামলাটি দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের ৩রা জুলাই রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলাটি দায়ের করা হয়। ২০০৯ সালের ৫ই আগস্ট আসামীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।
অভিযোগপত্রে বেগম খালেদা জিয়া, তার বড় ছেলে তারেক রহমান, সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমানকে আসামী করা হয়।
অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পরবর্তী যুক্তিতর্ক উপস্থানের দিন আগামী ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারী ধার্য্য রয়েছে। গত ১লা ফেব্রুয়ারী এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে পরবর্তী এ দিন ধার্য্য করা হয়। ওইদিন এ মামলার আসামী জিয়াউল ইসলাম মুন্নার পক্ষে টানা তৃতীয় দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তার আইনজীবী। এরআগে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে দাবী করে শুনানি করেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল।
দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল দুটি মামলারই প্রধান আসামী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ২০১০ সালের ৮ই আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করে দুদক। চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। ২০১২ সালের ১৬ই জানুয়ারী মামলার তদন্ত কর্মকর্তা(আইও) দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশীদ বেগম খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়া ছাড়া অপর তিন আসামী হলেন ঃ খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিট্যাবল উভয় মামলায়ই ২০১৪ সালের ১৯শে মার্চ আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায়।