॥আশিকুর রহমান॥ চীনের সমুদ্র উপকূলে ইরানি তেলবাহী ট্যাংকার ও জাহাজের সংঘর্ষের ১০দিন পেরিয়ে গেলেও ওই দুর্ঘটনায় নিখোঁজ রাজবাড়ী সদর উপজেলার সজীব মৃধাসহ দুই বাংলাদেশি নাবিকের কোনো সন্ধান মেলেনি।
নিখোঁজ দুই বাংলাদেশী হলেন ঃ রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়েনর মতিয়াগাছি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে কর্মচারী মাজেদ আলী মৃধার ছেলে মোঃ সজীব আলী মৃধা(২৬) ও চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার মিঠানালা ইউনিয়নের রাঘবপুর গ্রামের সাদেক আহমেদের ছেলে মোঃ হারুন-অর রশিদ(৩৭)।
গত ৬ই জানুয়ারি রাতে ‘দি সানচি’ নামের তেলবাহী ট্যাংকার ইরান থেকে তেল বহন করে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু পূর্ব চীন সাগরের সাংহাই উপকূল থকে ২৬৯ কিলোমিটার দূরে হং কংয়ের সিএফ ক্রিসটাল জাহাজের সঙ্গে সানচির সংঘর্ষ হয়। এ দুর্ঘটনার পর ওই ট্যাংকারে থাকা ৩০জন ইরানি এবং দুই বাংলাদেশী সজীব ও হারুন নিখোঁজ হন। পরে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় নিখোঁজ তিনজনের লাশ পাওয়া যায়।
এদিকে দুর্ঘটনায় সজীবের নিখোঁজের খবরে তার পরিবারে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন বাবা মাজেদ আলী মৃধা ও মা জোসনা বেগম। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে শোকে কাতরাচ্ছেন সজীবের দুই বোন জিনিয়া আক্তার ও শাবনাজ আক্তার। নিখোঁজ অপর নাবিক হারুন-অর রশিদের পরিবারেও চলছে শোকের মাতম।
সজীবের বাবা-মা ও ছোট বোন শাবনাজ বর্তমানে ঢাকায় তার বড় বোন জিনিয়ার বাসায় রয়েছেন। আজ
১৭ই জানুয়ারী সজীবের দুলাভাই মোঃ জাকির হোসেনের সঙ্গে এবং হারুন অর-রশিদের বড়ভাই সামসুল আলম টিপুর সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
এ সময় জাকির হোসেন বলেন, আমার শ্বশুরের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী সদর উপজেলার বরাট ইউনিয়নে। তবে তিনি রেলওয়েতে চাকরির সুবাদে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে থাকতেন। গত ১বছর ধরে তিনি অবসরে রয়েছেন। সজীব পার্বতীপুরের জ্ঞানাঙ্কুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে। এরপর সে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১০ সালে আবারও জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাশ করে। ২০১৩ সালে সে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী থেকে ব্যাচেলর অব মেরিটাইম সায়েন্স(বিএমএস) ডিগ্রি অর্জন করে। ২০১৪ সাল থেকে সজীব দুইটি বাল্ক ক্যারিয়ার ও দুইটি ওয়েল ট্যাংকার জাহাজে কাজ করেছে। সর্বশেষ সে ২০১৭ সালের ১৭ই নভেম্বর জামালপুরের এস.কে ইঞ্জিনিয়ারিং এজেন্সির মাধ্যমে ন্যাশনাল ইরানিয়ান ট্যাংকার কোম্পানি-এনআইটিসির ‘দি সানচি ট্যাংকারে’ থার্ড অফিসার হিসেবে যোগদেন।
গত ৩রা জানুয়ারী রাতে সজীবের সঙ্গে তার মায়ের সর্বশেষ কথা হয়। তখন সজীব বলেছিলো- ৭ই জানুয়ারীর পর আবার কথা হবে। কিন্তু ৭ই জানুয়ারী আমরা জানতে পারি ‘দি সানচি ট্যাংকারটি’ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সজীব নিখোঁজ রয়েছে। আমরা খবর পেয়েছি ওই দুর্ঘটনায় যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের সবাই নাকি মারা গেছেন। এ খবরে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি শোকে পাথর হয়ে গেছেন। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখন একটিই দাবি-আমরা সজীবের মরদেহটি শেষবারের মতো দেখতে চাই।
জাকির হোসেন বলেন, আমরা জানতে পেরেছি দুর্ঘটনায় নিখোঁজ ৩২জনের মধ্যে ৩জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে সজীবের মরদেহ আছে কি না তা সজীবের বাবা ও বোনের ডিএনএ মিলিয়ে সনাক্ত করা হবে। আজ ১৭ই জানুয়ারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সজীবের বাবা ও বোনের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। ওই রিপোর্ট বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চীনের পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
অপরদিকে নিখোঁজ হারুন-অর-রশিদের বড়ভাই সামশুল আলম টিপু বলেন, আমার ছোটভাই হারুন এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের বাবা। ২০১৭ সালের ২০শে নভেম্বর সে জামালপুরের এস.কে ইঞ্জিনিয়ারিং এজেন্সির মাধ্যমে ন্যাশনাল ইরানিয়ান ট্যাংকার কোম্পানি-এনআইটিসির ‘দি সানচি ট্যাংকারে’ কাজে যোগদেন। দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ আগে তার স্ত্রীর সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। ৭ই জানুয়ারী আমরা দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। হারুনের মরদেহ শনাক্তের জন্য আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ পরীক্ষা করতে দিয়েছি। সরকারের কাছে দাবি আমার ভাইয়ের মরদেহটি যেনো দেশে এনে নিজ হাতে দাফনের সুযোগ করে দেন।
এদিকে এ বিষয়ে কথা বলতে জামালপুরের এস.কে ইঞ্জিনিয়ারিং এজেন্সির পরিচালক আব্দুল মান্নানের মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ওই এজেন্সির অফিস স্টাফ টিপুর নম্বরে ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, সজীব ও হারুন আমাদের এজেন্সির মাধ্যমেই ‘দি সানচি ট্যাংকারে’ কাজে যোগ দিয়েছিলেন। দুর্ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তাদের মরদেহের খোঁজ করে দেশে ফিরিয়ে আনতে আমাদের এজেন্সির পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে।