Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

বহু গুণ ও প্রতিভার অধিকারী মনীষী ছিলেন ড.কাজী মোতাহার হোসেন —রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী

॥মোক্তার হোসেন॥ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গতকাল ৯ই অক্টোবর দুপুরে জ্ঞানতাপস জাতীয় অধ্যাপক ড.কাজী মোতাহার হোসেনের ৩৬তম মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে জেলার পাংশা উপজেলার হাবাসপুরস্থ ড.কাজী মোতাহার হোসেন কলেজ মিলনায়তনে স্মরণ সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী।
অনুষ্ঠানে মূল আলোচক হিসেবে ড.কাজী মোতাহার হোসেনের জীবন ও কর্মের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেন এয়াকুব আলী চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ফরিদ হাসান ওদুদ, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার(পাংশা সার্কেল) মোঃ ফজলুল করিম বক্তব্য রাখেন।
অন্যান্যের মধ্যে হাবাসপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল আলীম, পাংশা জর্জ পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে.এম নজীব উল্লাহ, ড.কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল আজিজ ও হাবাসপুর কে.রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মসলেম উদ্দিন মনির বক্তব্য রাখেন।
প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী বলেন, আজ থেকে ১২০ বছর আগে অজো পল্লী গ্রামে মহামনীষী ড.কাজী মোতাহার হোসেনের জন্ম। এই অঞ্চলের মানুষের সাথে তার নাড়ির টান ছিল।
তিনি কখনো নৌকায়, কখনো ঘোড়ার গাড়ী, কখনো বা মহিষের গাড়ীতে গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে আসতেন। গ্রামে এসে তিনি তার বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নিতেন। বাড়ীতে এসে এলাকায় শিক্ষা, ক্রীড়া ও সামাজিক সেবামূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতেন তিনি।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী বলেন, বহু গুণ ও প্রতিভার অধিকারী মনীষী ছিলেন ড.কাজী মোতাহার হোসেন। তিনি ছিলেন অল রাউন্ডারদের অলরাউন্ডার। বুদ্ধির মুক্তি-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টি বিষয়ে তিনি অধ্যাপনা করেছেন যা বিরল দৃষ্টান্ত।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, ছাত্র জীবনে খুবই মেধাবী ছিলেন ড.কাজী মোতাহার হোসেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম স্থান নিয়ে এমএ পাস করেন তিনি। সে বছর কেউই প্রথম শ্রেণি পাননি। ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এম.এ এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে পিএইচডি করেন তিনি। ড.কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ডেমনেস্ট্রেটর হিসেবে চাকুরী শুরু করেন এবং একই বিভাগে ১৯২৩ সালে সহকারী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ড.কাজী মোতাহার হোসেন নিজ উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ চালু করে ওই বিভাগে যোগ দেন। গণিত বিভাগেও শিক্ষকতা করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অনারারী অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেন।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী বলেন, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়– ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে দাবা খেলার পথিকৃৎ হিসেবে সম্মানিত হন তিনি। ১৯৬৬ সালে প্রবন্ধ সাহিত্যের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৭৯ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার, ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে অবদানের জন্য ডিএসসি ডিগ্রি এবং ১৯৭৫ সালে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত হন ড.কাজী মোতাহার হোসেন।
প্রধান অতিথি বলেন, অত্র এলাকায় ড. কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, এয়াকুব আলী চৌধুরী ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনাসহ অনেক গুণীজনের জন্ম হয়েছে। এসব গুণীমানুষের জীবন ও কর্ম অনুস্মরণের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের আদর্শ জীবন গড়ার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি। জ্ঞানতাপস ড. কাজী মোতাহার হোসেনের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য এলাকাবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে চলতি অর্থবছরে কলেজের মাঠ ভরাটের জন্য বড় ধরনের একটি বরাদ্দ দেওয়া ও কলেজের ভবন সংস্কার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের আশ্বাস ব্যক্ত করেন তিনি। এছাড়া কলেজ মাঠে ড.কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি অডিটোরিয়াম ভবন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও দাপ্তরিক সহযোগীতা প্রদানের আশ্বাস ব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী অনুষ্ঠানের মূল আলোচক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ৩৩বছর আগে ফরিদপুর সরকারী রাজেন্দ্র কলেজে আমি স্যারের ছাত্র ছিলাম। তিনি বাংলা বিষয়ে ক্লাস নিতেন। আমি তন্ময় হয়ে ক্লাসে স্যারের কথা শুনতাম।
অনুষ্ঠানের মূল আলোচক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব বলেন, মহুমুখী প্রতিভার উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন ড.কাজী মোতাহার হোসেন। সমাজের প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। মুক্ত বুদ্ধির চর্চা আন্দোলনকে ঘিরে সাহিত্যিক আবুল হোসেন ও কাজী আব্দুল ওদুদকে সাথে নিয়ে শিখা পত্রিকা বের করেন তিনি। ড.কাজী মোতাহার হোসেন সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে ছিলেন। তার লেখায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ ছিল না। ড. কাজী মোতাহার হোসেনের পৈত্রিক বাড়ী বাহাদুরপুর ইউপির বাগমারা কাজীপাড়া গ্রামে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লক্ষèীপুর গ্রামের তার মামা বাড়ীতে ১৮৯৭ সালের ৩০শে জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কাজী গওহর উদ্দিন আহমদ ছিলেন সেটেলমেন্টের একজন আমিন। ৮৪ বছর বয়সে ১৯৮১ সালে ৯ই অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিকাশ চন্দ্র বসু। উপস্থাপনার মাঝে ড.কাজী মোতাহার হোসেনের জীবনাদর্শের স্মৃতিচারণ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন সেনগ্রাম ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মোঃ আওয়াবুল্লাহ ইব্রাহীম। অনুষ্ঠানে ড. কাজী মোতাহার হোসেন স্মরণে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন অত্র কলেজের ছাত্র হিমেল শেখ ও শামীম হোসেন।
অনুষ্ঠানে পাংশা থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন, ড.কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের উপাধ্যক্ষ মোঃ তোফাজ্জেল হোসেন, হাবাসপুর কে.রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নির্মল কুমার সাহা ও মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম পাকু প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।