॥স্টাফ রিপোর্টার॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবীন সেনা অফিসারদের বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার মত নিজেদেরকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে-বিদেশে আমাদের সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই, সর্বক্ষেত্রে তাঁরা দক্ষ থাকবে, উপযুক্ত থাকবে এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হবে-সারাবিশে^র যেখানেই যাবে সেখানেই যেন দেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পার সেদিকে সর্বদা সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী গতকাল ২৪শে ডিসেম্বর সকালে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিস্থ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে অনুষ্ঠিত ‘রাষ্ট্রপতি প্যারেড ডিসেম্বর-২০২০ এবং ৭৯ বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্স সমাপনী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য যা যা প্রয়োজন সেটা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, জাতির পিতার কাঙ্খিত ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে সার্বিকভাবে কাজ করা হচ্ছে এবং সেই লক্ষ্যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাশপাশি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে উন্নয়নের কাজ চলছে।
তিনি বলেন, ’৪১ সালে বিশে^ বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ। সেই সময় দেশ পরিচালনায় আরো উঁচু মানের অফিসার হিসেবে আজকের যারা নবীন সেই তোমরাই দায়িত্ব পালন করবে। আমরা ’৪১ এর দেশ গড়ার সৈনিক হিসেবে তোমরাই দায়িত্ব পালন করবে। সে কথাটা মাথায় রেখেই নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তোমাদের পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে আমাদের সেনাবাহিনী প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে এবং দেশে-বিদেশে সুনাম অর্জন করছে।
তিনি বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের সেনাবাহিনী যথেষ্ট অবদান রেখে যাচ্ছে। এর ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষায় অনেক অবদান আমাদের সেবাহিনীর অফিসাররা রেখে যাচ্ছেন এবং প্রতিটি দেশেই আমাদের সশস্র বাহিনী তথা সেনাবাহিনীর প্রশংসা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রশংসা যখন আমরা শুনি তখন সত্যিই গর্বে আমার বুক ভরে যায়। সেজন্য সকলকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
বর্তমান কোভিড-১৯ সময়কে বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশে^র জন্যই একটি ‘ক্রান্তিকাল’ আখ্যায়িত করে সরকার প্রধান বলেন, এরফলে আমার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে, জীবনযাত্রা সীমিত হয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনে দুর্ভোগ আসছে।
তিনি বলেন, এই করোনা মোকাবেলায় আমাদের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করা, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো এবং সাহায্য করায় বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সেবাহিনীকে ‘জনগণের সেনাবাহিনী’ আখ্যায়িত করে আরো বলেন, ‘এজন্য যেকোন দুর্যোগ মোকাবেলায় বা যে কোন সমস্যায় আমি দেখেছি আমাদের সেনাসদস্যরা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।’
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে বিভিন্ন কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নবীন ক্যাডেটদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন। ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার মাহমুদুল হাসান শ্রেষ্ঠ চৌকষ ক্যাডেট হিসেবে ‘সোর্ড অব অনার’ লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর অর্জন করায় ‘সেনাবাহিনী প্রধান স্বর্ণ পদক’ও অর্জন করেন। অনুষ্ঠানে নবীন ক্যাডেটদের শপথ বাক্য পাঠ করানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সালাম জানানো হয় এবং প্রধানমন্ত্রী নবীন ক্যাডেটদের মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা তাঁর দূরদর্শী চিন্তার মাধ্যমে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের উপযোগী উন্নত ও পেশাদার সশস্ত্র বাহিনীর অপরিসীম গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে কারণেই একটি প্রশিক্ষিত, শক্তিশালী ও দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসে ‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি’র উদ্বোধন করেন। যা ছিল বাংলাদেশের জন্য এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
জাতির পিতা ১৯৭৪ সালেই আমাদের জন্য ‘প্রতিরক্ষা নীতি’ প্রণয়ন করেন, উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, জাতির পিতা প্রণীত সুদূরপ্রসারী প্রতিরক্ষা নীতির আলোকেই সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য আমরা ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ প্রণয়ন করেছি। এর আওতায় আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন নতুন পদাতিক ডিভিশন, ব্রিগেড, ইউনিট ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সকল স্তরে নারীর অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের সরকার ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে মহিলা অফিসার নিয়োগ এবং ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম মহিলা সৈনিক ভর্তির যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
‘বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিকে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অত্যাধুনিক একাডেমিতে পরিণত করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে যাচ্ছে,’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এ সময় জাতির পিতার ভাষণের উদ্ধৃতি- ‘বিশ্বের মানুষ একদিন এই মিলিটারি একাডেমিকে দেখতে আসবে’-এর উল্লেখ করেন এবং আজকে সত্যিই সারাবিশে^র মানুষ আমাদের মিলিটারি একাডেমি দেখতে আসছে এবং তারা এটার প্রশংসাও করেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রসঙ্গে আরো বলেন, উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান ও সুযোগ্য নেতৃত্ব তৈরিতে বঙ্গবন্ধু যে মিলিটারি একাডেমির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারই বাস্তবায়িত রূপ আজকের এই একাডেমি।
তিনি বলেন, এখানে ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণের সকল প্রকার অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ‘বঙ্গবন্ধু কমপ্লেক্স’সহ বিবিধ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়াও ৩বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ৪বছর মেয়াদী অনার্স কোর্স নিঃসন্দেহে সামরিক ও বৈশ্বিক জ্ঞানের মিশ্রনে সামরিক পেশাগত উৎকর্ষতার শিখরে পৌঁছাতে সহায়ক হবে, বলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সেনাসদস্যরা যাতে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেটা নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরবর্তীকালেও এই শিক্ষাটা তাঁদের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে কাজে দেবে।
তিন বছর মেয়াদি কঠোর প্রশিক্ষণ শেষ করে আজ ৭৯তম বিএমএ দীর্ঘ মেয়াদী কোর্সে বাংলাদেশসহ বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র প্যালেস্টাইন ও শ্রীলঙ্কার প্রশিক্ষণার্থীরা ‘লেফটেন্যান্ট’ হিসেবে কমিশন লাভ করতে যাচ্ছে। আজকের এই শুভক্ষণে আমি সকল নবীন অফিসারকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।
প্রধানমন্ত্রী পাসিং আউট ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকের দিনটি তোমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ প্রশিক্ষণের পর কাক্সিক্ষত কমিশন প্রাপ্তির মাধ্যমে তোমরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত অফিসার হিসেবে আজ যোগদান করতে যাচ্ছ।
তিনি বলেন, দেশকে ভালবাসতে হবে এবং দেশের জন্য কর্তব্য পালন করতে হবে। কারণ, তোমরা যে শপথ গ্রহণ করেছ এই শপথ গ্রহণের মধ্যদিয়ে তোমাদের এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বিরাট দায়িত্ব কাঁধে পড়লো। সেকথা সব সময় মনে রাখতে হবে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার পাসিং আউট প্যারেডে প্রদত্ত ভাষণের উদ্ধৃতি দেন।
জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘আমি তোমাদের জাতির পিতা হিসাবে আদেশ দিচ্ছি, তোমরা সৎ পথে থেকে মাতৃভূমিকে ভালো বাইসো। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবা, গুরুজনকে মেন, সৎ পথে থেক, শৃঙ্খলা রেখ, তা হলে জীবনে মানুষ হতে পারবা।’
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার এই বক্তব্যের আলোকে বলেন, জীবনে সব থেকে বড় জিনিস হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা এবং দেশ মাতৃকাকে ভালবাসা।
তিনি বলেন, জাতির পিতার এই নির্দেশনাটা আমি মনে করি, চলার পথে সবসময় মনে রাখতে হবে। তোমরা এদেশের সন্তান। এদেশের গ্রাম, গঞ্জে, শহরে তোমাদের মা-বাবাসহ সকলে ছড়িয়ে আছেন। কাজেই, দেশের উন্নতি হলে সকলেরই উন্নতি হবে। দেশ শান্তিতে থাকলে সবাই শান্তিতে থাকবে। সে কথাটা সবসময় মনে রেখে এ দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জীবন মান উন্নয়নের জন্য যথাযথভাবে অবদান রেখে যাবে সেটাই আমরা চাই।
প্রধানমন্ত্রী ক্যাডেটদের প্রতি শুভ কামনা জানিয়ে বলেন, তোমরা নেতৃত্বে সফল হও, আরো দক্ষ হও, সুশিক্ষিত হও- দেশ ও জাতি তোমাদের জন্য সবসময় গর্ব অনুভব করবে- সেটাই আমি চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় অর্জনকারী একটা দেশ। আমরা বিজয়ী জাতি। জাতির পিতার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। কাজেই, সেই কথাটা মাথায় রেখে সবসময় যেন মাথা উঁচু করে আমরা বিশ^ দরবারে চলতে পারি সেভাইে নিজেকে তৈরি করতে হবে এবং দেশের মান মর্যাদা সমুন্নত রাখতে হবে।