॥স্টাফ রিপোর্টার॥ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গতকাল ২রা ডিসেম্বর বেলা ১১টায় কালেক্টরেটের সম্মেলন কক্ষে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রশাসক ও কমিটির সভাপতি দিলসাদ বেগমের সভাপতিত্বে সভায় কমিটির উপদেষ্টা রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী, রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিম, পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম(বার), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) খন্দকার মুশফিকুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শফিকুল ইসলাম শেখ ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সাঈদুজ্জামান খান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় কমিটির অন্যান্য সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী বলেন, রাজবাড়ী জেলায় প্রতি বছর বেশ কয়েকটা মৌজার বালু মহাল লীজ দেওয়া হয়। এই সমস্ত বালু মহালের মধ্যে সবক’টি বালু মহালের লীজ বাতিল করা হোক সেটি আমি কখনো মনে করি না। তবে ধাওয়াপাড়া ঘাট সংলগ্ন বালু মহালসহ যে কয়টা বালু মহাল নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করছে সে সমস্ত বালু মহালের লীজ দেওয়ার ব্যাপারে আমি আমার আপত্তির কথা বলেছি। প্রতি বছর নদী ভাঙ্গনের কারণে রাজবাড়ী জেলার নদী তীরবর্তী মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার নির্বাচনী এলাকার এই নদী ভাঙ্গন কবলিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণসহ স্থায়ী ভাঙ্গন প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙ্গনসহ ভাঙ্গন প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত প্রকল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেগুলো মেরামত করতে আবারও কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী আরো বলেন, বালু মহাল লীজ প্রদানের সময় ইজারাদারদের যে সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হয় পরে সেই সীমানা আর ঠিক থাকে না। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে গিয়েও তারা বালু উত্তোলন করে। শুধু তাই নয়-ইজারা পাওয়ার পর অনেক ইজারাদারই আবার সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়, সে আবার অন্যদের সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়, এভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। এ কারণে সবসময়ই নদীর বিভিন্ন স্থানে শতাধিক জায়গা থেকে বালু উত্তোলন করতে দেখা যায়। উত্তোলিত টন টন বালু শত শত বলগেটের মাধ্যমে নদীর পাড়ে এনে পাহাড়ের মতো স্তুপ করে রেখে বিক্রি করা হয়। সেখান থেকে রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক লোড বহনকারী দশ চাকার ট্রাকে করে বিভিন্ন জায়গায় বালু পরিবহন করা হয়। এই সকল কাজে প্রতিদিন ইজারাদার কর্তৃক সাব-ইজারার অর্থসহ নদীতে বালু পরিবহন কাজে নিয়োজিত বলগেট থেকে প্রতি সিএফটি বালুতে তিন টাকা করে এবং সড়ক পথে বালু পরিবহনের কাজে নিয়োজিত ছোট-বড় বিভিন্ন ট্রাক থেকে বিভিন্ন হারে প্রতিদিন ১৫-২০ লক্ষ টাকার মতো চাঁদা আদায় করা হয়, যা পরবর্তীতে ভাগাভাগির মাধ্যমে বন্টন করা হয়। আর এই বালু উত্তোলনের কারণে বর্তমানে নদী তীরবর্তী তিনটি স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও সাধারণ মানুষের বাড়ীঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে প্রায় বেড়িবাঁধের কাছে চলে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে রাজবাড়ী শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হবে। তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না। তাই আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তিনি বলেন, নদীর তীরবর্তী এলাকার লোকজন আমার কাছে অভিযোগ করেছে যে, বালুর সাথে সংশ্লিষ্টদের কারণে তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। সে কারণে আমি আমার নির্বাচনী এলাকার জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনার প্রেক্ষিতে বালুমহাল বন্ধ করতে বলেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তার প্রদত্ত রিপোর্টে বলেছেন, শুধু নদী থেকে বালু কাটার কারণে নদী ভাঙ্গন হয় না- অন্য কারণেও নদী ভাঙ্গন হতে পারে। অপরদিকে নদী পাড়ের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারীদের অভিযোগ, বালু উত্তোলনের কারণেই প্রতি বছর নদী ভাঙ্গন হচ্ছে। এই ২টি দিক বিবেচনা করে আমাদের উচিত আগামী দুই বছর বালু মহাল ইজারা বন্ধ রাখা। আর ভারী যানবাহনে বালু পরিবহন করার কারণে রাস্তার ক্ষতিসহ নতুন রাস্তা নির্মাণে যে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে সে জন্য আগামী ২মাস বালুবাহী ট্রাকও বন্ধ রাখা উচিত।
তিনি পুলিশ সুপারকে রাস্তায় অধিক লোডের দশ চাকার বালুভর্তি ট্রাক চলাচল ও চাঁদাবাজী বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
কমিটির অপর উপদেষ্টা রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম বলেন, বালুমহাল সংক্রান্ত কোন বিষয় নিয়ে আমার কখনও কোন ইন্টারেস্ট ছিল না- এখনও নাই। আমি বিভিন্ন সময় অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধের কথা বলেছি। পাংশা ও কালুখালী উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। অবৈধভাবে যারা বালু কাটে তারা যেখানে ভালো বালু পায় সেখান থেকেই বালু কাটে। এ জন্য তারা নির্ধারিত সীমারেখা ভঙ্গ করে। নদীর ভাঙ্গন শুধু বালু উত্তোলনের কারণেই হয় না, অনেক সময় নদীর মাঝখানে চর পড়ায় ¯্রােতের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে তীরে আঘাত করাসহ বিভিন্ন কারণে নদী ভাঙ্গন হতে পারে। আবার বালু উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে সেক্ষেত্রে অনেকে চুরি করে বালু উত্তোলনের চেষ্টা করবে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে কালুখালী উপজেলার প্রস্তাবিত সেনানিবাস এলাকার প্রায় ৬০ ভাগ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, বালু উত্তোলনের জন্য রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য খাসচর এলাকার বালুমহল ইজারা প্রদানের জন্য অনুমোদন করে এনেছিলেন। আমরা যখন এতো সচেতন, তাই যদি বন্ধ করতে হয়ে তাহলে সেটিও বন্ধ করতে হবে। তবে কোন কিছু করার আগে আমি মনে করি কমিটির সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের উচিত বালু কাটার কারণে আসলেই নদী ভাঙ্গন হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি নদী সার্ভের কাজে পারদর্শী সরকারী প্রতিষ্ঠান যেমন- নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েট, বিআইডব্লিউটিএ বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দিয়ে সার্ভে করে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বালুমহাল ইজারা প্রদান করা বা বন্ধ করা। কারণ বালু মহালে কাজ করে আমাদের এলাকার অনেক মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। বালু পরিবহনের কাজে যে দশ চাকার ট্রাক চলাচল করে রাস্তার ক্ষতিসাধন করছে সেগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আর ছয় চাকার যে সমস্ত ট্রাক বালু পরিবহন করছে সেগুলো যাতে সঠিক লোড নিয়ে রাস্তায় চলাচল করে সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। আবার নদীতে বালু পরিবহনের বলগেট ও সড়কে ট্রাক থেকে থেকে যে চাঁদা তোলা হয় সেটিও বন্ধ করতে হবে। দশ চাকার হেভি লোড নিয়ে ট্রাক চলার কারণে পাংশা উপজেলার হাবাসপুরসহ বিভিন্ন এলাকার কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নদীর তীরে যেসব বালুর পাহাড় করা হয়েছে সেগুলো সরিয়ে নিরাপদ দুরত্বে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এই বালুর লোডের কারণে নদী ভাঙ্গন না হয়। মোট কথা প্রশাসনকে বালুমহাল ইজারা প্রদানের সকল শর্ত ইজারাদার পালন করছে কিনা সেটি কঠিন মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ সময় এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিম বালুমহাল সংক্রান্ত কয়েকটি প্রস্তাব সভায় পেশ করেন। তা হচ্ছে ঃ বালুমহাল ইজারা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে দশ চাকার ট্রাক চলাচল বন্ধ করা, এরপর বালু মহালে বালু কাটার ক্ষেত্রে চুক্তির সকল নিয়ম মেনে চলা, বলগেটসহ বালু পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পরিবহন থেকে চাঁদাবাজী বন্ধ করা এবং নদীর পাড় থেকে বালুর পাহাড় দূরে সরিয়ে নেওয়া-যাতে নদীর পার বা বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
তিনি বলেন আমি মনে করি এই নিয়মগুলো যদি ইজারাদার মেনে চলে ও তাদেরকে কঠোর মনিটরিং করা যায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই নদী ভাঙ্গনসহ অন্য সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে এসব কিছু করার আগে বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙ্গন হচ্ছে কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সার্ভে করানো জরুরী বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর বিভিন্ন জায়গায় সরকারীভাবে মোট ৬টি বালুমহাল ইজারা দেওয়ার অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে ৫টি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে সরকারী রাজস্ব আদায় হচ্ছে। এসব বালু মহালের বালু রাস্তার ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অধিক লোডের যানবাহনে পরিবহনের কারণে রাস্তা নষ্ট হচ্ছে বলে সড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছিল। স্থানীয় জনগণেরও এ বিষয়ে অনেক আপত্তি রয়েছে। সব বিষয় বিবেচনা করে আজকে রাজবাড়ী জেলার ২জন সংসদ সদস্যেসহ পুলিশ সুপার, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণসহ সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে করণীয় ঠিক করা হবে। সভায় এই বালু উত্তোলনের ফলে নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। উপস্থিত সকলে সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দিয়ে বালু মহাল থেকে বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙ্গন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সার্ভে করানোর জন্য মত প্রকাশ করেছেন। সকলের মতের প্রেক্ষিতে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সার্ভে করানোর ব্যবস্থা করানো হবে। সার্ভের রিপোর্ট পাওয়ার পর ভবিষ্যতে ইজারা প্রদান করা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। যেহেতু সার্ভে রিপোর্ট পেতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে সেক্ষেত্রে সার্ভে করানোর আগ পর্যন্ত ইজারার সকল শর্তাবলী কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ইজারা প্রদান করা হবে। ইজারাদার কোন শর্ত ভঙ্গ করলে তার ইজারা বাতিল করা হবে। আর নদীতে কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সার্ভে রিপোর্ট পাওয়ার পর যদি দেখা যায় বালু কাটার কারণে নদী ভাঙ্গন হচ্ছে তবে তখন তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এছাড়াও সভায় বালুমহাল সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বালুমহাল কমিটির সভা শেষে একই স্থানে জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়।