Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

চামড়া শিল্পের উন্নয়ন

## আবু সালেহ মোহাম্মদ মুসা ## বিকাশমান শিল্পের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশে চামড়া শিল্প অন্যতম। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ১৯৭২ সালে ৩৫টি মাঝারি, ২৫টি ক্ষুদ্র ট্যানারি নিয়ে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে চামড়া শিল্পে আমাদের রপ্তানি আয় ১দশমিক ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১২বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের পরই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চামড়া শিল্পের অবস্থান। ২০২১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার আর চামড়া ও চামড়াজাত শিল্প থেকে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে বলে আশা করা যায়।
আমাদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড়ো বাজার হলো- ইতালি, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন, সিংগাপুর, স্পেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারত, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ানসহ বেশ কয়েকটি দেশ। বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত চামড়ার পাশাপাশি চামড়া থেকে তৈরি জুতা, ব্যাগ, জ্যাকেট, হাতমোজা, ওয়ালেট, বেল্ট, মানিব্যাগসহ চামড়ার তৈরি হস্তশিল্প পণ্যসামগ্রী বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজারের ২১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে মাত্র ০.৫ ভাগ রপ্তানি করে। স্বাধীনতার পর ৩৫টি মাঝারি ট্যানারির মধ্যে অবাঙালিদের মালিকানার ৩০টি ট্যানারি সরকার অধিগ্রহণ করে কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে এসব ট্যানারি লাভজনক শিল্পে রূপ নিতে পারেনি। ফলে বিরাষ্ট্রীয়করণ প্রক্রিয়ায় এসব ট্যানারি ব্যক্তি মালিকানায় চলে যায়। বর্তমানে দেশে ট্যানারির সংখ্যা প্রায় ২০০টি।
বর্তমান সরকার চামড়া শিল্পকে একটি উল্লেখযোগ্য স্থানে নিয়ে যেতে গত দিনগুলিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে যেগুলো বাস্তবায়িত এবং কয়েকটি চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে অবস্থিত ট্যানারি শিল্প হাজারিবাগ থেকে সরিয়ে সাভারে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিয়েছে। একটি হিসাবে, বাংলাদেশে প্রাপ্ত ২২ কোটি বর্গফুট চামড়ার মধ্যে গরুর চামড়া ৫০ লাখ পিস, ছাগল এক কোটি পিস এবং মহিষ ও ভেড়া ১৫ লাখ পিস। এর মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ২.৭৫ কোটি বর্গফুটের মতো।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রাপ্ত চামড়ার প্রায় অর্ধেকই সংগৃহীত হয় কোরবানির ঈদে। গত বছরগুলিতে এক শ্রেণির স্বার্থন্বেষী মহল বৈদেশিক চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে কোরবানির পরপরই সাতক্ষীরা, যশোর সীমান্তসহ দেশের অন্যান্য সীমান্ত পথে কাঁচা চামড়া পাচারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কতিপয় দালাল কোরবানির আগেই অগ্রিম টাকা সরবরাহ করে এ চামড়াগুলোর এক বিরাট অংশ নিজেদের দখলে রাখে যা কাঁচা অবস্থায় পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে এ সময় অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য সরকারী উদ্যোগে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা থাকলেও চামড়া শিল্প মালিকদের বক্তব্য হচ্ছে- অর্থ প্রদানের এ ঋণ সুবিধা খুবই অপ্রতুল। তাই ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে ও সীমান্ত এলাকায় চামড়া পাচাররোধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এ শিল্পকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে তেমনি চামড়া নিয়ে দুর্নীতি দমনে আরো এক ধাপ অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা জাপান। জাপান শুরু থেকেই বাংলাদেশি চামড়ার জুতার ক্ষেত্রে ‘ডিউটি ও কোটা ফ্রি’ সুবিধা চালু রেখেছে। এ কারণেই জাপানের বাজারেই মোট রপ্তানি পণ্যের ৫৫ থকে ৬০ শতাংশ যায়। বাংলাদেশের এখন লক্ষ্য জুতার বাজার নিজেদের দখলে নেয়া। চীনের চামড়া শিল্পের ওপর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১২-২০১৩ সালে চীনে তৈরি জুতা শিল্পের উৎপাদন ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রাপ্ততথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশে ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা তৈরি হয়। ১১০টি জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের শিল্প কারখানার মধ্যে জুতা তৈরিতে “আ্যাপেক্স” সবচেয়ে এগিয়ে আছে। এ কোম্পানিটি প্রতিদিন তাদের নিজস্ব কারখানায় ২০ হাজার জোড়া জুতা তৈরি করে। এছাড়া বিদেশি বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি যেমন এবিসি মার্ট, এলডো, টিম্বারল্যান্ড কোম্পানির পছন্দমতো জুতা সরবরাহ করে থাকে।
চামড়া শিল্পের কিছু ক্ষতিকর প্রভাব চোখে পড়ে- চামড়া শিল্প এলাকা মূলত হাজারিবাগ। ঐ এলাকায় দেশের ৯০ শতাংশ ট্যানারি স্থাপিত থাকায় এলাকার মাটি, পানি, বাতাস দূষিত হওয়ায় সরকারি উদ্যোগে সাভারে স্থানান্তর সম্পন্ন হলে এ সমস্যার অনেকখানি সমাধান হবে। কিছু কিছু অভিযোগ বিশ্লে¬ষণ করে দেখা গেছে, এখনো অনেক ট্যানারিতে শিশুশ্রম বহাল আছে। বর্তমান সময়ে এ অব্যবস্থার অবসান হওয়া জরুরী। সাভার চামড়া শিল্পকে পরিবেশবান্ধব করার সকল উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করলেও বাস্তবে এর সুফল এখনো আসেনি।
ট্যানারি স্থানান্তরিত হওয়ায় ও উন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি তুলেছে যে কারণে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তরিত হলো সেই পরিবেশ দূষণ যেন সাভারেও লক্ষ্য করা না যায় সে উদ্যোগ এখনই নেওয়া প্রয়োজন। নতুবা তুরাগ, ধলেশ্বরী নদী দূষিত হবে। এ শিল্পে কমর্রত প্রায় ২৫হাজার শ্রমিকের বিষয়টি সরকারের বিশেষ বিবেচনায় আনতে হবে। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে নানা ধরনের রাসায়নিকের মধ্যে ক্রোম পাউডার, সোডিয়াম, কপার সালফেট, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড, ব্লি¬চিং পাউডার, অ্যাসিড ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা এগুলো ব্যবহারে বাধ্য হয়। প্রতিটি ট্যানারিতে এ ব্যাপারে যাতে যথাযথ নিয়ম প্রতিপালিত হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি উদ্যোগে উপযুক্ত তদারকি নিশ্চিত হলে চামড়া শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হবে। বিষয়টি বিদেশি ক্রেতাদের অধিকতর আকৃষ্ট করবে।
বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ২৬০ মিলিয়ন বর্গফুট ফিনিশড লেদার রপ্তানি করেছে যদিও এ সময় উৎপাদিত ফিনিশড লেদারের পরিমাণ ছিল ২৮০ মিলিয়ন বর্গফুট। অথচ একটু পিছনে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশ কাঁচা চামড়া বা “ওয়েট ব্লু লেদার” এবং “ক্রাস্ট লেদার” বা প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করতো। সময়ের ব্যবধানে চামড়া শিল্পের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি এখন ট্যানারি মালিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এ শিল্প অবশ্যই বাংলাদেশের বৃহৎ শিল্পে রূপ নেবে- এ বিশ্বাস সকলের। -পিআইডি প্রবন্ধ।