॥মোক্তার হোসেন॥ রাজবাড়ী জেলার পাংশায় গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বস্তরের মানুষের শোক, শ্রদ্ধা আর অশ্রুসিক্ত ভালবাসায় চির বিদায় নিয়েছেন পাংশা উপজেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ রাজনীতিবিদ, একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা খান আব্দুল হাই(হাই সাহেব)।
আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা খান আব্দুল হাই গতকাল ১৬ই আগস্ট ভোররাত পৌনে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি—রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৩বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২পুত্র, ১কন্যা সন্তান, ৩ভাই, নাতি-নাতনী আত্মীয়-স্বজন, অসংখ্য গুণগ্রাহী, শুভাকাঙ্খী রেখে গেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খান আব্দুল হাই মৃত্যু’র সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পাংশা, কালুখালী, বালিয়াকান্দি তথা রাজবাড়ী জেলার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মরহুমের মৃতদেহ প্রথমে রাজবাড়ী জেলা পরিষদ চত্বরে নেওয়া হলে রাজবাড়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বারসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মরহুমের কফিনে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর মৃতদেহ রাজবাড়ী স্টেডিয়ামের সামনে নেওয়া হয়।
সেখানে রাজবাড়ী জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আলহাজ্ব আলী আকবর মর্জির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দ মরহুমের কফিনে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর পাংশা উপজেলার যশাই ইউপির যশাই গ্রামের নিজ পৈত্রিক বাড়ীতে মরহুমের মৃতদেহ নেওয়া হলে সর্বস্তরের মানুষ শেষবারের মত একনজর দেখতে ভীড় জমায় এবং শ্রদ্ধ নিবেদন করে।
পরে বাদ জোহর মরহুমের নিজ হাতে গড়া যশাই উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রথম জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর মরহুমের দ্বিতীয় নামাজে জানাযা পাংশা জর্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
জানাযার পূর্বে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ও রাজবাড়ী-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী, রাজবাড়ী-২ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম, রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী, পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি, বিপিএম-সেবা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার, সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুল হক সাবু, সাবেক এমপি ও পাংশা উপজেলা পরিষদের প্রাক্তণ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন মিয়া, সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা মসলেম উদ্দিন মোমেন, সাবেক জেলা পরিষদের প্রশাসক আলী আকবর মর্জি, ডেপুর্টি এ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট ফরহাদ আহম্মেদ, কুমারখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল মান্নান খান, রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ফরিদ হাসান ওদুদ, পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, পাংশা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আহসান উল্লাহ, পাংশা পৌরসভার মেয়র আব্দুল আল মাসুদ বিশ্বাস, কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী হক, পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পাংশা সরকারী কলেজের উপাধ্যক্ষ একেএম শফিকুল মোরশেদ আরুজ, পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাংশা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ হাসান আলী বিশ্বাস, যশাই ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা চাঁদ আলী খানসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, পাংশা প্রেসক্লাবের সভাপতি মোঃ মোক্তার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রেজা শিশিরসহ সাংবাদিকগণ এবং বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ মরহুমের কফিনে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জানাযার পূর্বে মরহুমের কফিন সামনে রেখে গার্ড অব অনার প্রদান করে রাজবাড়ী জেলা পুলিশের চৌকষ একটি দল। বিউগলের করুণ সুরে তখন পাংশা জর্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উপস্থিত হাজারো মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে।
এ সময় মরহুমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয় এবং মরহুমের জেষ্ঠ্য পুত্র হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল কবির মুরাদ পিতার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য উপস্থিত সকলের কাছে দোয়া কামনা করেন।
পাংশা সরকারী কলেজ মসজিদের ইমাম মাওলানা মোঃ আহসান উল্লাহ পাংশা জর্জ পাইলট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত জানাযার নামাজে ইমামতি করেন। জানাজার নামাজ শেষে পাংশা পৌরসভার কেন্দ্রীয় কবরস্থানে মরহুমের দাফন সম্পন্ন করা হয়।
মরহুম খান আব্দুল হাই-এর শিক্ষা জীবন শুরু হয় মাছপাড়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৪ সালে হাবাসপুর কে.রাজ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন তিনি। সে সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ছাত্রলীগ রাজনীতির সুবাদে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়। ওই সময় ছাত্র রাজনীতির কারণে যতবার জেলে গেছেন ততবারই বঙ্গবন্ধু নিজে গিয়ে তাকে কারামুক্ত করেন। বৃহত্তর ফরিদপুরের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধুসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সাথে তার রাজনৈতিক সখ্যতা গড়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন খান আব্দুল হাই। ১৯৬৯ সালে যশোর, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর এলাকায় ছাত্র আন্দোলন ও গণ আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে ৮নং সেক্টরে প্রধান সেনাপতির স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে বীরত্বের সাথে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন তিনি।
স্বাধীনতাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাংশা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কর্মকান্ড পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৭৫’সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর চরম দুর্দিনে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন খান আব্দুল হাই। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের শত অত্যাচার-নির্যাতন, লোভ লালসায় তাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারে নাই। আশিরদশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে কারা নির্যাতনের শিকার হন তিনি। এরপর বিএনপি-জাতীয় পার্টির সময়ে হামলা-মামলা, ঘরবাড়ী ভাংচুর, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন তিনি। দুর্দিনের সময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহর-গ্রামে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ গণমানুষের সামনে তুলে ধরেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তিনি পাংশায় নিজের মালিকানাধীন মুক্তি প্রেস থেকে সাপ্তাহিক পদ্মা বার্তা নামক পত্রিকা প্রকাশনা করেন এবং ওই তিনি পাংশা প্রেসক্লাবের সভাপতিও নির্বাচিত হন। শেষ জীবনে তিনি আওয়ামী লীগের পদ-পদবী থেকে বঞ্চিত হন।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন॥পাংশায় শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় চির বিদায় নিলেন প্রবীণ আ’লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা খান আব্দুল হাই
