Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

সকল অফিসেই কম-বেশী দুর্নীতি আছে॥দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে ——— দুদক কমিশনার ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান

॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন॥ “এবার আওয়াজ তুলুন” শ্লোগানকে সামনে রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর আয়োজনে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় গতকাল ৭ই আগস্ট বিকাল ৪টায় সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারী অফিসসমূহের দুর্নীতি বিষয়ক গণশুনানী সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান।
গণশুনানীতে মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক নাসিম আনোয়ার।
গণশুনানীতে অন্যান্যের মধ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার, পৌরসভার মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খালেক প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে সেবা প্রদানকারী সদর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারী অফিসসমূহের কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণকারীদের লিখিত অভিযোগের জবাব দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ সাঈদুজ্জামান খান।
এ সময় পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি বিপিএম-সেবা, দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় ফরিদপুরের উপ-পরিচালক মোঃ ফজলুল হক, সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ রহিম বক্স, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মোঃ আশেক হাসান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ ছাদেকুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাকিব খান, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খান এ শামীম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ, দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় ফরিদপুরের সহকারী পরিচালক মোঃ শাহরিয়ার জামিল, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি প্রফেসর মোঃ কুদরত আলী, সাধারণ সম্পাদক মোঃ তোসলিম উদ্দিন, সনাকের সভাপতি প্রফেসর শংকর চন্দ্র সিনহা, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাগণ, সদর উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানগণ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধিগণ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ, বিভিন্ন পেশার সাধারণ নাগরিকগণসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ড. মোঃ মোজাম্মেল হক খান সমাপনী বক্তব্যে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই দেশের যেসব জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে সেগুলো বন্ধ করা সম্ভব হবে। আর সেই লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০১৪ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ৯৯টি গণশুনানী করেছে। দেশের দু’একটি অফিসেরই মধ্যেই কেবল দুর্নীতি সীমাবদ্ধ না। সকল অফিসেই কম-বেশী দুর্নীতি আছে। আর এই দুর্নীতি দূর করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সকলকে দুর্নীতিমুক্ত হয়ে একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। কোন কাজের ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্নীতি না করে পরিষ্কারভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, চাকুরী জীবনের শুরু থেকেই একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে এমন কোন দপ্তর নেই যেখানে আমি কাজ করিনি। কোন অফিসে কিভাবে দুর্নীতি হয়, কারা দুর্নীতি করে সে সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) মূলতঃ দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে। রাষ্ট্রের নাগরিক যে কোন ব্যক্তি এই কমিশনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করতে পারে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে অভিযোগকারীকে অবশ্যই নিজের থেকে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। আজকের গণশুনানীতে যে অভিযোগগুলো পাওয়া গেল সেগুলো অবশ্যই দুর্নীতি দমন কমিশন যাচাই-বাছাই করে যে অভিযোগগুলো এখানে সমাধান পাওয়া যায়নি সেগুলো খতিয়ে দেখবে। এমন এক সময় ছিল যখন বিভিন্ন কারণে সরকারী দপ্তরে জনসাধারণের সেবার পরিধি সীমিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে জনবান্ধব সরকার হওয়ায় সেই পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতি না থাকলে আমাদের দেশের আরো উন্নতি হতো। দুর্নীতির সাথে কখনো আপোষ করবো না, এমন মনোবল আমাদের রয়েছে। দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের নিকট যে অভিযোগগুলো জমা পড়ে সেগুলোর ক্ষেত্রে তদন্তে দু’একটি ঠিক থাকলেও অধিকাংশই সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ঘাটতি থাকার কারণে বাতিল হয়ে যায়। কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে তার অভিযোগ আইনীভাবে প্রমাণ করতে হয়। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের ভিডিও রেকর্ডিংসহ অন্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ দায়ের হলে দুর্নীতি দমন কমিশন যাচাই বাছাই করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রে অনেক সময়ই দুদক দুর্নীতি দমনে সফল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
তিনি তার বক্তব্যে আরও বলেন, এই গণশুনানীর মাধ্যমে দুর্নীতি দমন কমিশন মানুষকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন করছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিভাবে কমিশনে অভিযোগ করতে হয় তা শিখিয়ে দিচ্ছে। বর্তমানে অনেক সেবাদানকারী সরকারী প্রতিষ্ঠান আছে যাদের জনকল্যাণে সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ঠিকমতো সেবা প্রদান করছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকা। আজকে যে অভিযোগগুলো আমাদের কাছে এসেছে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তদন্ত করা হবে।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী তার বক্তব্যে বলেন, উপস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনার সিনিয়র সচিব থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি আমাদের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গর্ব। আজকে দুর্নীতি দমন কমিশন যে গণশুনানীর আয়োজন করেছে এর মাধ্যমে সেবা গ্রহীতারা দুর্নীতির বিষয়ে তাদের বিভিন্ন অভিযোগ করতে পারবেন ও সেবা প্রদানকারীরা তাদের সেই অভিযোগ খন্ডন করবেন। যার মাধ্যমে সেবা গ্রহীতার সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম হয়েছে কিনা সে বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার হবে। যদি এক্ষেত্রে কোন দুর্নীতি বা অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে দুদকের কোন সন্দেহ থাকে তাহলে তারা তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমাদের সকলেরই মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাদের সেবা প্রদান করতে সরকার আমাদেরকে নিয়োগ করেছেন। যে কোন সরকারী দপ্তর থেকে জনগণ যাতে সেবা নিতে গিয়ে কোন রকম হয়রানী বা দুর্নীতির শিকার না হন সে বিষয়টি মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। আর সেটি না করে আমরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হই তবে সেই দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ দুর্নীত বন্ধে সরকার স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য যে, দুর্নীতি দমন কমিশন আয়োজিত গণশুনানীতে জেলা ও সদর উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারী অফিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনেক লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। তার মধ্যে ১৪টি অভিযোগ অভিযোগকারীরা সরাসরি উত্থাপনের সুযোগ পান।
এর মধ্যে অভিযোগকারী মোঃ আশরাফুল ইসলাম সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের বিরুদ্ধে জমির দলিল সম্পাদনসহ বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের বিষয়ে পৌর মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, রাজবাড়ী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদন করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়া হয় বলে অনেক অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। আজকের পর থেকে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোন অতিরিক্ত অর্থ নিলে জনগণই তাদেরকে হাতেনাতে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে তুলে দেবে। প্রথম অভিযোগকারী আশরাফুল ইসলাম একই ধরণের অভিযোগ ২টি করায় জেলা প্রশাসক তাতে প্রশ্ন করেন এটি তার নিজের বা পারিবারিক জমি সংক্রান্ত অভিযোগ কিনা এবং তার পরিচয় জানতে চান। তখন অভিযোগকারী আশরাফুল ইসলাম বলেন, তিনি রাজবাড়ী কৃষি ব্যাংকের একজন গার্ড। এটি তার নিজের জমির অভিযোগ না। তার আত্মীয় প্রতিবেশীর জমির দলিলের কাজ করতে রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে এই ঘটনা ঘটে। এতে উপস্থিত অনেকে তাকে দালাল আখ্যা দেন এবং তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান।
অভিযোগের জবাবে সদর সাব-রেজিস্ট্রার বলেন, দলিল সম্পাদনের স্ট্যাম্প ও অন্যান্য খরচ বাবদ অর্থ নেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগকারী যে অধিক অর্থ নেওয়ার কথা বলেছে তা সত্য নয়।
আপর অভিযোগকারী সোহেল রানা তার লিখিত অভিযোগে রাজবাড়ী সিভিল সার্জন অফিসের সহকারী প্রধান পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ দিয়ে চাকুরী, পদোন্নতি, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক নাসিম আনোয়ার বলেন, যেহেতু এই অভিযোগের সাথে সরকারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ও দুদকের তফসীল অনুযায়ী তদন্তযোগ্য সেহেতু কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে দেখবে।
এ প্রসঙ্গে সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ রহিম বক্স বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে আত্মকলহের কারণে কিছু কর্মচারী তার বিরুদ্ধে আমার কাছেও এই ধরণের লিখিত অভিযোগ করেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। সেই কমিটি তদন্ত সাপেক্ষে আমার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
সদর হাসপাতালে রোগীদের ওষুধ না পাওয়া, ডাক্তারদের ঠিকমতো রোগী না দেখা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন সংক্রান্ত বিষয়ে চায়না আক্তার নামের একজন লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। জবাবে হাসপাতালের তত্বাবধায়ক বলেন, দীর্ঘ সময় টেন্ডার জটিলতার কারণে ওষুধ সাপ্লাই না পাওয়ায় অনেক ওষুধই সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে ওষুধের সরবরাহ পাওয়ায় রোগীদের দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতি রোগীর জন্য সরকারী বরাদ্দ ১২৫ টাকা। যার মধ্যে সকালে ৩০ টাকার নাস্তা দেওয়া হয়। বাকী অর্থ দিয়ে দুপুর ও রাতের খাবার দেয়া হয়।
বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী জামশেদ আলম তার অভিযোগে বলেন, রাজবাড়ী পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে গেলে সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে হয়রানীর শিকার হচ্ছে। এক্ষেত্রে দালালের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে পাসপোর্ট করালে কোন রকম হয়রানী ছাড়াই পাসপোর্ট পাওয়া যায়। তার অভিযোগ সমর্থন করে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খালেক বলেন, আমি নিজে পাসপোর্ট করতে গেলে আমাকে যে তারিখে পাসপোর্ট দেয়ার কথা ছিল সেই তারিখে আমি পাসপোর্ট পাইনি। একজন জনপ্রতিনিধি হওয়া স্বত্ত্বেও আমার ক্ষেত্রে যদি এই হয়, তাহলে সাধারণ জনগণের বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট কর্মকর্তা বলেন, আমি যোগদানের পর হয়রানী বন্ধে অভিযোগ বাক্স স্থাপন ও গণশুনানীসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
এছাড়াও উপজেলা ভূমি অফিসে সরকারী জমি লীজ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-ওজোপাডিকোর বিদ্যুৎ বিল ও সরবরাহ লাইন ইত্যাদি বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। জবাবে ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জিএম অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন।