Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে টিপসই নিয়ে বৃদ্ধের জমি আত্মসাত

॥আশিকুর রহমান॥ রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর ইউনিয়নের ধুলদী লক্ষীপুর গ্রামে গরজন খাঁন(৭৫) নামে এক বৃদ্ধকে বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা করে দলিলে টিপসই নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন আপন ভাতিজা ও তার সহযোগিসহ দলিল লেখক।
বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকাবাসীর চাপের মুখে গরজন খাঁনকে জমি বাবদ এক লাখ টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত টাকাটি দেওয়া হয়নি।
গতকাল ৩রা জুন দুপুরে সরেজমিনে গরজন খানের বাড়িতে গেলে তিনি ও তার স্ত্রী হাফিজা বেগম জানান, তাদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। সাত বছর আগে ছেলে সাহিদ খাঁন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মেয়েরা তাদের দরিদ্র স্বামীর ঘরে সংসার করছেন। ছেলে সাহিদের স্ত্রী ও দুই ছেলে আলাদা বসবাস করে। তাদের সহায় সম্বল বলতে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ জমি রয়েছে। ওই জমি তাদের কাছ থেকে তাদের আপন ভাতিজা(গরজন খাঁনের আপন ভাই কাজেম খাঁনের ছেলে) রিপন খাঁন কিনে নিতে চান। ছেলে জীবিত না থাকায় মৃত্যু পর্যন্ত তাদের দেখভাল করার শর্তে তারা রিপনের কাছে জমি বিক্রি করতে রাজী হন।
গরজন খাঁন ও তার স্ত্রীর অভিযোগ, প্রায় তিন মাস আগে তাদের এলাকার এমদাদ ডাক্তার ও ইসলাম শেখ তাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনকে বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে অটোতে করে রাজবাড়ী শহরে নিয়ে যান। এরপর এমদাদ ও ইসলাম অটোটি এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে গরজন খানকে একটি কাগজ দেখিয়ে বলেন- ‘এই কাগজে টিপসই দিলে বয়স্ক ভাতার কার্ড পাওয়া যাবে।’ গরজন খান কাগজে টিপসই দেওয়ার পর সেই অটোতে করেই তাদের স্বামী-স্ত্রীকে আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর গরজন খাঁনের ভাতিজা রিপন জানায় তাদের তিন ভাইয়ের নামে জমি রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বলেন, গরজন খান বৃদ্ধ হয়ে গেছেন এবং তিনি একজন সহজ-সরল মানুষ। আমাদের এলাকার এমদাদ ডাক্তার, ইসলাম শেখ ও ফরহাদ মহুরির সঙ্গে যোগসাজস করে গরজন খাঁনের আপন ভাতিজা রিপন প্রতারণা করে তার জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। পরে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হলে এলাকাবাসীর চাপের মুখে ১৫দিন আগে ফরহাদ মহুরি, এমদাদ, ইসলাম, গরজন খাঁন ও তার ভাতিজা রিপনসহ এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিরা শালিসে বসে গরজন খাঁনকে জমি বাবদ এক লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, এখনো পর্যন্ত তাকে টাকা দেওয়া হয়নি।
গরজন খাঁনের মৃত ছেলের স্ত্রী সেলিনা বেগম জানান, এমদাদ ডাক্তার, ইসলাম শেখ ও রিপন তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে দলিলে সই নিয়ে জমি লিখে নিয়েছে। অথচ তারা এর কিছুই জানতেন না। পরে তার শ্বশুর বিষয়টি জানাজানি করেন। এরপর শালিসে বসে জমি বাবদ একলাখ টাকা দেওয়ার কথা হলেও তারা এখনো টাকা পাননি। তাদের লোকজন কেউ নেই, তাই ভয়ে তারা কিছু বলতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
গরজন খাঁনের মেয়ে কোহি বেগম জানান, তারা দরিদ্র মানুষ। প্রতারণা করে তার বাবার কাছ থেকে শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তার বাবা-মা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে গরজন খাঁনের ভাতিজা রিপন খাঁন বলেন, আমি প্রতারণা করে জমি লিখে নেইনি। আমার চাচার কাছ থেকে এক লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনে নিয়েছি। এক লাখ টাকার মধ্যে ৬০হাজার টাকা আমি এমদাদ ডাক্তার ও ইসলাম শেখের কাছে দিয়েছি। বাকি ৪০হাজার টাকা কয়দিন পর দিবো বলে জানিয়েছি। তারা আমার চাচা-চাচীকে রাজবাড়ী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নিয়ে আমাদের তিন ভাইয়ের নামে জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু, পরে আমি জানতে পারি আমার দেওয়া ৬০ হাজার টাকা চাচা-চাচী পাননি।
জমি কিনে নিলে টাকা সরাসরি আপনি আপনার চাচা-চাচীর হাতে দিতে পারতেন এবং আপনি সঙ্গে করে তাদের সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিতে পারতেন। এখানে অন্য লোকদের প্রয়োজন হলো কেন? রিপন খাঁনকে এমন প্রশ্ন করা হলে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এদিকে এ বিষয়ে কথা বলতে অভিযুক্ত এমদাদ ডাক্তারের নম্বরে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। অপর অভিযুক্ত ইসলাম শেখের নম্বরে ফোন দেওয়া হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোনটি কেটে বন্ধ করে রাখেন। পরে তার বাড়িতে গিয়ে জানা যায় তিনি সাংবাদিক আসার কথা শুনে বাড়ি থেকে সটকে পড়েছেন।
গরজন খাঁনের জমি রেজিস্ট্রি করা মহুরি ফরহাদ বলেন, এমদাদ ডাক্তার, ইসলাম শেখ ও রিপন আমাকে জানায় গরজন খাঁন তার ভাতিজা রিপন, জাহান ও জাহিরের নামে জমি দান করবেন। এজন্য তারা আমাকে হেবা-বিল-অ্যাওয়াজ (পারস্পারিক কিছুর বিনিময়ে দানপত্র) দলিল প্রস্তুত করতে বলেন। আমি দলিল প্রস্তুত করার পর এমদাদ ও ইসলাম জমি রেজিস্ট্রি করানোর জন্য গরজন খাঁন ও তার স্ত্রীকে অটোতে করে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে নিয়ে যান। অফিস চার তলায় হওয়াতে অসুস্থ্য গরজন খাঁন উপরে উঠতে পারছিলেন না। তাই অটোর মধ্যে তাকে বসিয়ে রেখে সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে আমি বিষয়টি জানাই। এরপর সাব-রেজিস্ট্রার তার অফিসের একজন পিয়নকে নিচে পাঠিয়ে গরজন খাঁনের সঙ্গে কথা বলান। পরে সাব-রেজিস্ট্রারের অনুমতিতে গরজন খাঁনের টিপসই নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়ার কথা বলে গরজন খাঁনকে রাজবাড়ী নেওয়া হয়েছে এটি আমি পরে জেনেছি। আমার কোনো দোষ নেই। মূলত এমদাদ ডাক্তার, ইসলাম শেখ ও রিপন জমি এবং টাকা আত্মসাৎ করার জন্য এ কাজটি করেছে।
এ বিষয়ে বসন্তপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর্জা বদিউজ্জামান বাবু বলেন, গরজন খাঁন একজন দরিদ্র বৃদ্ধ। প্রতারণার মাধ্যমে তার জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার ঘটনাটি আমি শুনেছি। এর চেয়ে নিকৃষ্টতম আর কোনো কাজ হয় না। ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। আমি একটু অসুস্থ্য আছি। সুস্থ্য হয়ে প্রয়োজনে আমি নিজে গরজন খাঁনের পক্ষ হয়ে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।