॥স্টাফ রিপোর্টার॥ সরকারী নির্দেশনাকে অমান্য করে জমি বেচাকেনা করতে আসা জনগণকে জিম্মি করে রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে অবৈধভাবে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের মহোৎসব।
ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার ও রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুবের প্রত্যক্ষ মদদে দলিল লেখকদের অবৈধ একটি সিন্ডিকেট প্রকাশ্যে অবৈধভাবে মোটা অংকের অর্থ আদায় করলেও পরিত্রান পাচ্ছে না জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা জনসাধারণ।
এ বিষয়ে সরেজমিন তথ্য সংগ্রহে গতকাল ২৮শে মে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দৈনিক কালের কণ্ঠ ও একুশে টিভি’র রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধি এবং প্রেসক্লাবের সহ-সম্পাদক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন পেশাগত দায়িত্ব পালনে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গেলে তথ্য সংগ্রহের এক পর্যায়ে রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুবের মদদে দলিল লেখকদের সিন্ডিকেট তাকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেওয়াসহ নাজেহাল ও তাকে হুমকী-ধামকী প্রদর্শন করে। এ সময় খবর পেয়ে থানা পুলিশ সেখানে উপস্থিত হলে দলিল লেখক সিন্ডিকেট সটকে পড়ে। পরে পুলিশ তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে।
সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, গত ২০শে মে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলীর সভাপতিত্বে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় কালুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী সাইফুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, নবগঠিত কালুখালী উপজেলায় এখনো সাব-রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হয়নি। যে কারণে পূর্বের ন্যায় কালুখালী উপজেলার জনগনকে তাদের জমি বেচাকেনার জন্য পাশ^বর্তী পাংশা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যেতে হয়। আর এ সুযোগে পাংশা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট নিয়ম বর্হিভূত ভাবে দলিলের মোট টাকার ১৪শতাংশ হারে অর্থ আদায় করে নিচ্ছে। আর রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্র্রি অফিস কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট নিচ্ছে ১০ শতাংশ হারে। ফলে বার্ষিক কয়েক কোটি টাকা ওই সিন্ডিকেট অবৈধভাবে হাতিয়ে নিয়ে সাধারণ জনগণকে আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। তাই তিনি কালুখালী উপজেলার মানুষের আর্থিক ক্ষতি কমাতে কালুখালীর জনগনকে রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে জমি রেজিস্ট্রি করার সুযোগ করে দেওয়ার দাবী জানান। এ প্রেক্ষিতে ওই সভায় জেলা প্রশাসক কোন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পাংশা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এই অতিরিক্ত অর্থ নিচ্ছে তা খতিয়ে দেখার জন্য এবং ভবিষ্যতে যাতে এই অতিরিক্ত অর্থ আর নেয়া না হয় সে জন্য জেলা রেজিস্ট্রারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল ২৮শে মে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজবাড়ী শহরের নারায়নবাবুর পুকুরচালা সংলগ্ন জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা, সেখানে জেলা রেজিস্ট্রার নেই।
ওই কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় থাকা অফিস সহকারী সুতপা রায় বলেন, জেলা রেজিস্ট্রার এএসএম সরোয়ার হোসেন চলতি বছরের গত ৩রা মার্চ অবসরে গেছেন। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুব।
তিনি আরো বলেন, বিগত এপ্রিল মাসে জেলার রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ৭৩০টি, পাংশা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ৮১৯টি, গোয়ালন্দ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১৫৫টি এবং বালিয়াকান্দি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ৪৩৮টিসহ মোট ২হাজার ১শত ৪২টি দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। আর ওই দলিল রেজিস্ট্রি বাবদ সরকারের আয় হয়েছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ ৭৪হাজার ৯৯ টাকা। তবে তিনি দলিল প্রতি কত টাকা কি কি ভাবে নেয়া হয় সে ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার ও রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুবের কাছে গিয়ে তথ্য নেবার অনুরোধ করে।
এরকিছু সময় পর বেলা ১২টার দিকে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন রাজবাড়ী পৌরসভা সংলগ্ন জজ ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যান।
তখন অফিস সহকারী গুরুদাস হালদার বলেন, স্যার (সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুব) এখনো আসেননি। সে সময় দলিল প্রতি কত টাকা কি কি ভাবে অর্থ নেয়া হয় এ প্রশ্নের জবাবে অফিস সহকারী গুরুদাস হালদার বলেন, তার পেছনের দেয়ালে প্রযোজ্য ফি ও করের বিবরণ চার্ড টানানো আছে সেটা দেখে নিতে। ওই চার্ডে দেখা যায়, কবলা দলিলের ফিস মূল্য ২ শতাংশ, ই ফিস এক শত টাকা, এন ফিস ৪০টাকা(প্রতি পৃষ্ঠা), স্থানীয় সরকার কর ৩শতাংশ, উৎস্য কর ১শতাংশ (পৌরসভার এলাকার বাহিরের জমি) এবং উৎস্য কর ২শতাংশ (পৌরসভার এলাকার জমি)। এতে দেখা যায়, কবলা দলিল প্রতি পৌরসভার এলাকার বাহিরের জমি শতকরা ৬শতাংশ এবং পৌরসভার এলাকার জমি শতকরা ৭শতাংশ হারে নেয়ার কথা।
সে সময় ওই কার্যালয়ে কবলা দলিল করতে আসা রাজবাড়ী সদর উপজেলার বসন্তপুর ইউনিয়নের বড় ভবানীপুর গ্রামের শেফালী বেগমের দুলাভাই এস.এম হাসান কানু বলেন, একই গ্রামের জনৈক কাজী নজরুল ইসলামের কাছ থেকে শেফালী বেগম ১লাখ ৫০হাজার টাকায় সাড়ে ৭শতাংশ জমি কবলা রেজিস্ট্রি করতে এ কার্যালয়ে এসেছেন। এ জন্য সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক কমল মহুরী তাদের কাছ থেকে ২০হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। যা কি না দলিল মূল্যের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে।
এরই মাঝে কার্যালয়ে প্রবেশ করেন ভারপ্রাপ্ত জেলা রেজিস্ট্রার ও রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রার গোলাম মাহাবুব। এ সময় জানতে চাইলে তিনি বলেন, কালুখালী উপজেলা চেয়ারম্যানের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসক তাকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নির্দেশনা আলোকে গত ২৪শে মে তিনি ঢাকার নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহা-পরিদর্শক(আইজিআর) খান আব্দুল মান্নানকে স্ব-শরীরে গিয়ে বিষয়টি অবহিত করেন। মহা-পরিদর্শক তাকে আগামী বুধবার পাংশা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস পরিদর্শন পূর্বক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন প্রদান করতে বলেছেন।
সে সময় তিনি দাবী করেন, সততার সাথে তিনি রাজবাড়ীতে দায়িত্ব পালন করছেন। রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের আওতাধীন কোন দলিল লেখক সরকারী নির্দেশনার বাইরে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করেন না। যদি টাকা নিয়ে থাকেন তাহলে ওই দলিল লেখকের সনদ তিনি বাতিল করবেন।
তার ওই কথার ভিত্তিতে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেন তার(সাব-রেজিস্ট্রিারের) সামনে তাৎক্ষণিকভাবে কবলা দলিল রেজিস্ট্রি করতে আসা শেফালী বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলিল লেখক তার কাছ থেকে ১লাখ ৫০হাজার টাকা মূল্যের দলিলের ফি বাবদ ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করেছে। তখন তার অভিযোগটি সাব-রেজিস্টার রেজিস্ট্রি অফিসের অভিযোগের খাতায় নিজে হাতে লেখেন এবং দলিল লেখক কমল মহুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন।
এ সময় সাব-রেজিস্ট্রারের কক্ষে উপস্থিত দলিল লেখকরা সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সাব-রেজিস্ট্রারের সামনেই তারা তাকে গালাগাল করার পাশাপাশি তাকে অবরুদ্ধ করে নানা রকম হুমকী প্রদর্শন করতে থাকে। ওই সময় সাব-রেজিস্ট্রার সুকৌশলে উপস্থিত দলিল লেখকদের উসকে দিয়ে নিজ কার্যালয় ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে খবর পেয়ে কয়েকজন সাংবাদিক ও রাজবাড়ী থানা পুলিশের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হলে হুমকী প্রদানকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে সটকে পরে।
এ ব্যাপারে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী জানান, কালুখালী উপজেলা চেয়ারম্যান অভিযোগ তদন্তাধীন। তিনি আরো বলেন, সারা দেশেই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক ও তাদের সমিতির নামে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করছে। যার ব্যতিক্রম রাজবাড়ীতেও নয়। ফলে অভিযোগ পেলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একাধিক সুত্র জানায়, অবৈধ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আদায়কৃত অর্থ থেকে সাব-রেজিস্ট্রার দলিল প্রতি কমপক্ষে ৩হাজার টাকার এবং অফিসের কর্মচারীগণ ২হাজার টাকা ঘুষ নেন। এছাড়াও অভিযোগ দলিল লেখক সিন্ডিকেট সাব-রেজিস্টার ও তার অফিসের কর্মচারীদের সাথে যোগসাজসে ভুয়া টিআইএন নম্বর ব্যবহার করে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে সরকারের বিপুল পরিমান অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
এদিকে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাঁধা প্রদানের পাশাপাশি রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সহ-সম্পাদক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের রাজবাড়ী জেলা প্রতিনিধিকে হুমকী প্রদানের ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজবাড়ী প্রেসক্লাবের সভাপতি এডঃ খান মোঃ জহুরুল হক, সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার আব্দুল মতিন, জেলা টেলিভিশন সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী আব্দুল কুদ্দুস বাবু, রাজবাড়ী রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি মোঃ ইউসুফ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মোঃ শিহাবুর রহমান, জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি লিটন চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক এজাজ আহম্মদ এবং রাজবাড়ী সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি খন্দকার রবিউল ইসলাম মজনু।
সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ঘুষ-দুর্নীতির অবৈধ সিন্ডিকেট বন্ধ করতে এবং সাংবাদিককে হুমকী প্রদানকারীদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন।
অপরদিকে সাংবাদিক জাহাঙ্গীর হোসেনকে নাজেহালের পর অবৈধ দলিল লেখক সিন্ডিকেটের সদস্যরা সাব-রেজিস্টারকে রক্ষার ও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচী পালনের চেষ্টা করে। এ সময় খবর পেয়ে অন্যান্য সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হলে মানববন্ধন কর্মসূচী পন্ড হয়ে যায়।