Site icon দৈনিক মাতৃকণ্ঠ

৪৬বছরেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি বেথুলিয়ার সৈয়দ আলী

॥শিহাবুর রহমান॥ সৈয়দ আলী মোল্লা। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় ছিলেন তরতাজা এক তরুন। শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকায় একদল মুক্তিযোদ্ধা তার দায়িত্ব দিয়েছিল নৌকার বইট্যা টানার। এরপর তিনি শুধু নৌকার বইট্যা টানাই নয় উজ্জীবিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের “মুজিব বাইয়া যাওরে নির্যাতিতা দেশের মাঝে জনগণের নাওরে মুজিব বাইয়া যাওরে” গান শুনিয়ে। নৌকার মাঝিগিরি করার পাশাপাশি করেছেন যুদ্ধও। শুধু তাই নয় নদীর মধ্যে পাকসেনাদের গুলিতে আহতও হয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার ৪৬বছরেও সেই সৈয়দ আলীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি মেলেনি। সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাইতে আবেদন করেও রয়েছেন দ্বিধাভূক্তির তালিকায়। আর তাই ৬৭বছর বয়সেও নৈশ্য প্রহরীর চাকুরী করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে তাকে। সৈয়দ আলীর বাড়ী রাজবাড়ী জেলা সদরের রামকান্তপুর ইউনিয়নের বেথুলিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত মইজদ্দিন মোল্লা।
সৈয়দ আলী জানান, তারা ছিলেন ৩ভাই। পরিবারে অভাব থাকায় স্বাধীনতার যুদ্ধের আগে তিনি আলাদিপুর গ্রামে হোসেন আলী দেওয়ানের বাড়ীতে থেকে কাজ করতেন। এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হলে হোসেন আলী দেওয়ান যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে যাওয়ার আগে তিনি তাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যান। শরীরে শক্তি থাকায় তাকে নৌকার মাঝির দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের নৌকায় মোট ৫জন মাঝি ছিল। একটি বড় নৌকায় তারা ৪০/৫০জন মুক্তিযোদ্ধাকে নদীতে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। তিনি শুধু নৌকার মাঝিই ছিলেন না। রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন নিউকোলনী, ২৮ কলোনী, গোলঘর ও আলাদিপুর নামক স্থানগুলোতে। প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন চরনারায়নুর স্কুল গনি মিয়ার ক্যাম্পে।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তিনি আরো বলেন, নদীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পারাপারের সময় তিনি “মুজিব বাইয়া যাওরে নির্যাতিতা দেশের মাঝে জনগণের নাওরে মুজিব বাইয়া যাওরে” গান শুনিয়ে তাদের উজ্জীবিত করতেন। একবার ধুনচি এলাকায় নদীর মধ্যে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে তিনি আহত হন। এ যাত্রায় গুলিটি তার থোড়ার উপরে লাগলে প্রাণে বেঁচে যান। এরপর দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের এক মাস পরেই তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর আনসারে ট্রেনিং নিয়ে যোগ দেন জিআরপি থানায়। সেখানে ১২/১৪বছর চাকুরী করার পর তিনি যোগ দেন সদর থানায়। ১৯৯৮ সালে সদর থানা থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি যখন চাকুরীতে যোগদান করেন তখন তার বেতন ছিল ৬৫০টাকা। আর যখন অবসর গ্রহণ করেন তখন বেতন ছিল ১৪শত টাকা। তার ছিল ছয় মেয়ে ও এক ছেলে। এই অল্প উপার্জন দিয়েও তিনি ৬ মেয়েকে মানুষ করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন। চাকুরী থেকে অবসরের পর তিনি রাজবাড়ী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নৈশ্য প্রহরীর চাকুরী নেন। সেখানে বেতন পান ৩হাজার টাকা।
তিনি আরো জানান, বসত বাড়ীর ২২শতাশং জমি ছাড়া তার আর কিছুই ছিল না। ওই ২২শতাংশ জমি ৬ মেয়ে ও এক ছেলেকে ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার পর তিনি পেয়েছেন মাত্র ৫শতাশং। নিজের বলতে শুধু ওই ৫শতাংশ জমিই। স্ত্রী ভানু খাতুন এখনো বেঁচে থাকায় তারা দুজন থাকেন ছোট্ট একটি ছাপড়া ঘরের মধ্যে। কয়েক বছর আগে একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীকে নিয়ে একই বাড়ীতে সে পৃথকভাবে বসবাস করে।
স্বাধীনতার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকার মাঝি ও কয়েকটি স্থানে স্বশরীরে যুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়ায় অনেকটা ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর দীর্ঘ কয়েক বছর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় না থাকায় তিনি মুক্তিযোদ্ধার সনদের জন্য আবেদন করেননি। কিন্তু এখন স্বাধীনতার পক্ষে শক্তি ক্ষমতায় থাকায় তিনি অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু যাচাই বাছাইতে তিনি দ্বিধাভূক্তের তালিকায় পড়ে যান।
তিনি আরো জানান, তিনি যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধার সাথে যুদ্ধ ও নৌকার মাঝি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা নেয়া করেছেন তাদের মধ্যে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ডাঃ কামরুল হাসান লালী, মুক্তিযোদ্ধা মোঃ হোসেন আলী দেওয়ান, মাইনুদ্দিন মন্ডল ও মোঃ আব্দুল গফুর পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যয়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও তিনি দ্বিধাভূক্ত হিসেবে চিহিৃত হন।
এ বিষয়ে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ডাঃ কামরুল হাসান লালী বলেন, সৈয়দ আলী আমাদের নৌকার মাঝি ছিল। এছাড়াও সে আমাদের সাথে কয়েক স্থানে যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নাম অর্ন্তভূক্তি হয়নি। এটা খুবই দুঃখজনক।